কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি নতুন ধরন বেরিয়েছে। বারবার রূপান্তর ঘটছে ভাইরাসটির। করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কিছুদিন আগেও বিভিন্ন দেশে বয়স্ক মানুষের ওপর টিকার বুস্টার ডোজের প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। কিন্তু এখন সেই বিতর্ক ছাপিয়ে সবাই বুস্টার ডোজের পেছনেই ছুটছে।
বিশ্বব্যাপী করোনার সর্বশেষ ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার আগেই মনে হয়েছিল, সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। টিকা নিলে গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে সেরে ওঠা সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল।
নতুন গবেষণা বলছে, আমাদের শরীর যাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হয়, অ্যান্টিবডির মাধ্যমে তা নিশ্চিত করে টিকা। তবে টিকা নিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা কমতে থাকে।
বিশ্বের যেসব দেশ আগেভাগেই জনগণকে ব্যাপকভাবে টিকার আওতায় এনেছে, ইসরায়েল সেসব দেশের অন্যতম। দেশটি বলছে, গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম ডোজ নেওয়ার তিন মাস পর ভাইরাসটির বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা কমতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় ডোজের কয়েক সপ্তাহ পর টিকার যে কার্যকারিতা ছিল, ছয় মাস পর তা অনেকটাই কমে গেছে। কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কারণে ছয় মাস পর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেছে আগের চেয়ে ১৫ গুণ।
এক বা দুই ডোজ টিকা অধিকাংশ ব্যক্তিকে গুরুতর অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা দিলেও ধীরে ধীরে করোনার বিরুদ্ধে টিকার প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যখন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের একটি অংশ টিকার আওতার বাইরে থাকেন বা তাঁদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা এমন অবস্থায় থাকে যে তাঁরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন।
সূত্র জানায়, আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাড়ে ছয় কোটি এখন পর্যন্ত এক ডোজ টিকাও পায়নি। গত এগারো মাসে এক ডোজ পেয়েছেন প্রায় সাত কোটি। এর মধ্যে ৪ কোটি ৮১ লাখের বেশি মানুষ পেয়েছে দ্বিতীয় ডোজ। সরকার সাড়ে ১৩ কোটির কিছু বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে টিকার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু নানা কারণে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এখন পর্যন্ত ৬০ বছরের বেশি কয়েক লাখ মানুষ টিকার আওতায় আসেনি।
অথচ এ অবস্থায় বুস্টার ডোজ নিয়ে তড়িঘড়ি শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু কার্যক্রম শুরুর পাঁচ দিনেও কেন্দ্রে নির্দেশনা না পৌঁছায় অনেকেই বুস্টার ডোজ ছাড়াই ফিরে আসছেন বলে অভিযোগ উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে বুস্টার ডোজের তোড়জোড়ে করোনা রোধে তেমন কাজে আসবে না। ফলে সবাইকে দুই ডোজ টিকা নিশ্চিত শেষে বুস্টার কর্মসূচি চালু করা উচিত বলে মনে করছেন তারা।
তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এর একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ওমিক্রনের কারণে বুস্টার ডোজ জরুরি হয়ে পড়েছে। ওমিক্রনের মিউটেশন (রূপান্তর) দেখে মনে হচ্ছে, এটি চীনের উহান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া ধরনের বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা। বাজারে প্রচলিত টিকাগুলো উহান থেকে ছড়ানো ধরন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছিল। আর এ কারণে এক বা দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর যাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছিল, ওমিক্রমনের বিরুদ্ধে তা তেমন কাজে দেবে না।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, করোনা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতে আগামী মার্চের মধ্যে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার মানুষকে দুই ডোজ অর্থাৎ ২৭ কোটি ৫ লাখ ৭৬ হাজার ডোজ টিকা দিতে হবে। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ কোটি ৮১ লাখ ২৩ হাজার ২৮৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৬ কোটি ৯৯ লাখ ৬২ হাজার ৩২৯ জন। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৬০ হাজার ৪২৫ জন। এ ছাড়া ৬ কোটি ৫৩ লাখ ২৫ হাজার ৬৭১ জন কোনো টিকাই পায়নি। গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ষাটোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ টিকার বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে করোনা মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণে অদক্ষতার চিত্র ফুটে উঠছে। এই বিশালসংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া ছাড়াই বুস্টার ডোজের ব্যাপারে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ২৭ জানুয়ারির পর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৩১ শতাংশকে এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। অথচ চলতি বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। সেটাও বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। এখন আগামী মার্চের মধ্যে ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার প্রাপ্তবয়স্ককে পূর্ণ ডোজ দেওয়ার কথা বলছে।
একইভাবে ৮০ শতাংশের বাইরে চলতি বছরের ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি ৩ কোটি স্কুল শিক্ষার্থীকে ফাইজারের টিকা দেওয়ার টার্গেট নেওয়া হয়। কিন্তু ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৯০ হাজার ৫২৯ জনকে প্রথম এবং ২ লাখ ৯৫ হাজার ১৯৯ জনকে দুই ডোজ দেওয়া হয়েছে। সবমিলে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী টিকা আওতায় এসেছে।
সূত্র জানায়, দেশে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৩১ লাখ। করোনা টিকা পেতে এই বয়সিদের ৭৫ শতাংশ নিবন্ধন করছেন। তাদের মধ্যে ৮২ লাখ ৫৩ হাজার (৬৩ শতাংশ) প্রথম এবং ৫২ লাখ ৪০ হাজার (৪০ শতাংশ) দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন। এ হিসাবে সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার জন (৩৭ শতাংশ) প্রথম এবং ৭৮ লাখ ৬০ হাজার (৬০ শতাংশ) এখনো পূর্ণ ডোজের আওতায় আসেনি।
বিপুল সংখ্যক বয়সোর্ধ মানুষ পূর্ণ টিকা না পেলেও বুস্টার ডোজ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে বেশ ভালোভাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির জানান, ‘বুস্টার ডোজ দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে সব হিসাব-নিকাশ আছে। যাদের বয়স ষাটোর্ধ্ব এবং যাদের রিস্ক-ফ্যাক্টর আছে, তাদের সব তথ্যই রয়েছে। সুতরাং বুস্টার প্রয়োগে নতুন রেজিস্ট্রেশন লাগবে না। অ্যাপস প্রস্তুত হয়ে গেলে তাদের মুঠোফোনে মেসেজ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সে মোতাবেক নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন।’
উল্লেখ্য, দেশে গত রোববার (১৯ ডিসেম্বর) বুস্টার টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ওইদিন পাঁচ মন্ত্রী ও ফ্রন্টলাইনারসহ ৬০ জন টিকা নেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত দুই দিনে (২২ ডিসেম্বর) দেশে ১৩ জন পুরুষ ও ৯ জন নারীসহ ২২ জনকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথম করোনা টিকা নিয়েছিলেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা। তিনিই প্রথম বুস্টার ডোজ নিয়েছেন।