জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এদেশে কর্মরত সব বহুজাতিক কোম্পানিসহ বৈদেশিক লেনদেনে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ধরনের লেনদেনের তথ্য চেয়েছে। ওই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ৯২১টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিস্তারিত তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর ফাঁকি চিহ্নিত করা হবে। একই সঙ্গে তাদের কোনো ধরনের অর্থপাচার রয়েছে কিনা তাও পরীক্ষা করা হবে। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে এনবিআরের আওতাধীন ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আলাদাভাবে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নির্ধারিত সময় আগামী ১৫ তারিখের মধ্যে আন্তর্জাতিক লেনদেনে জড়িত যেসব তথ্য পাঠাতে ব্যর্থ হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য বা ফাংশনাল প্রোফাইল পাঠিয়েছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে বৈদেশিক লেনদেনে জড়িত কোম্পানিগুলো কত দিন ধরে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কী ধরনের কার্যক্রম, মালিকানা, স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন, লেনদেনের পরিমাণ- এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠান কোন্ কোন্ এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে, কর্মীর সংখ্যা, নাম এবং এ সংক্রান্ত লেনদেনের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। ওসব তথ্য পরীক্ষা করার পর প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর ফাঁকি কিংবা কোনো ধরনের অনিয়ম বা অর্থপাচার রয়েছে কিনা তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি ইতিমধ্যে এনবিআর নিজস্ব উদ্যোগে শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানির স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠানো তথ্য পর্যালোচনায় কর ফাঁকিও উদ্ঘাটন হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় ওই অর্থ এনবিআরকে পরিশোধ করেছে।
সূত্র জানায়, বিদেশি কোম্পানিগুলোর শাখা কোম্পানির সুদ, মুনাফা, কোনো সম্পদ কিংবা পণ্যের মূল্য মূল কোম্পানিতে পাঠায়। তাছাড়া পণ্য বা সেবা আমদানির মূল্যও মূল কোম্পানি বা অন্য কোনো কোম্পানিকে পাঠায়। যা ট্রান্সফার প্রাইসিং হিসেবে পরিচিত। তবে পণ্যের দর কম বা বেশি দেখিয়ে কিংবা মুনাফার অর্থ প্রেরণে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কর ফাঁকির পাশাপাশি অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। এদেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে থাকে। কিন্তু কার্যকর কোনো উপায় না থাকায় ওসব কর ফাঁকি অধরাই রয়ে যাচ্ছে। সাধারণত যে সব দেশে কর হার বেশি সে দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে নানা কৌশলে কর হার কম এমন দেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর করা হয়। তাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ে, কিন্তু কর কম দিতে হয়। যা এক ধরনের অর্থপাচার। তাতে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বেশি কর রয়েছে এমন দেশগুলো। এভাবে বিশ্ব জুড়ে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি কর এড়িয়ে যায় বা ফাঁকি দেয়। অতীতে এনবিআর এ ধরনের কিছু ফাঁকি উদ্ঘাটনও করেছে।
সূত্র আরো জানায়, শুধু শাখা কোম্পানি এবং মূল কোম্পানি ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের নামে কারসাজির সঙ্গে জড়িত এমন নয়। অন্য কোনো কোম্পানি পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেও মূল্য কারসাজি করে থাকে। ফলেও সংশ্লিষ্ট দেশ কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। ইতিমধ্যে এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল থেকে বেশ কিছু বহুজাতিক কোম্পানির লেনদেনের বিশেষায়িত নিরীক্ষা করা হয়েছে। আরবছরে কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা আন্তর্জাতিক লেনদেন হয়, এমন শতাধিক কোম্পানির লেনদেনের তথ্য নিরীক্ষা করা হয়েছে।
এদিকে বহুজাতিক কোম্পানিসহ আন্তর্জাতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত কর আদায়ের লক্ষ্যে সরকার ২০১২ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন প্রণয়ন করে। তবে ২০১৪ সালে তার কার্যক্রম শুরু হয়। অবশ্য আইন প্রণয়নের এতোদিনেও বৈদেশিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোর লেনদেনে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। সম্প্রতি এনবিআরের বোর্ড সভায়ও ইস্যুটি উঠেছে। ওই সভায় ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের কার্যক্রম দৃশ্যমান করার বিষয়ে জোর দেয়ার পাশাপাশি একটি তথ্যভান্ডার তৈরিরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন প্রণয়ন ও এ সংক্রান্ত সেল গঠনের সঙ্গে যুক্ত এনবিআরের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করীম জানান, ইতিমধ্যে এর সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের কার্যক্রম পুরোদমে চালু হলে বড়ো অঙ্কের কর আদায় করা সম্ভব হবে।