করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের শুরুতে আবারও উচ্চ ঝুঁকিতে পড়েছে বিভাগীয় শহর রাজশাহী। এ এলাকায় জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। আর রাজশাহীতে ওমিক্রন শনাক্তের কোনো সুযোগ না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে এটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবেই হচ্ছে। দেশে ওমিক্রন প্রভাব বিস্তার করলেও রাজশাহীতে থাকা দুটি আরটি-পিসিআর ল্যাবে করোনার এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের কোনো সুযোগ নেই। ফলে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে পজিটিভ আসা রোগীরা ওমিক্রনে আক্রান্ত হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। এ কারণে এখানকার সন্দেহভাজন নমুনাগুলো ঢাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে গত বছর দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর মৃত্যু ও সংক্রমণের দিক থেকে শীর্ষে উঠেছিল ‘রাজশাহী’। সে সময় করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্টে এখানে একদিনে সর্বোচ্চ ২২ জনের প্রাণহানীও ঘটেছে। তাই আগের অভিজ্ঞতায় এবারের ঢেউয়ে এমনটি যেন না হয় এমন কথা বললেও রাজশাহীতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বালায় দেখা যাচ্ছে না। ফলে রাজশাহীর সচেতন মহলে আবারও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করলেও এ বিষয়ে অধিকাংশ জনসাধারন রয়েছে অন্ধকারে।
এদিকে করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই সরকারিভাবে দেশের মধ্যে রাজশাহী ও নাটোর জেলাকে হলুদ জোনের (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ) আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ায় বিভাগের অন্য জেলাতেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। আর সর্বশেষ সোমবার (১৭ জানুয়ারি) নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে বর্তমানে রাজশাহী জেলায় করোনা শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর আগের ২৪ ঘন্টায় গত রোববার (১৬ জানুয়ারি) ছিল ৩৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। ফলে গড়ে নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে রাজশাহীতে করোনা শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর সংক্রমণ এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা সংকট আগের চেয়েও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরপরও সাধারণ মানুষ মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীন। তাই রাজশাহী বিভাগে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে ডেল্টা ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে সর্বশেষ গত ২৪ ঘন্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে কোনো রোগীর মৃত্যুর ঘটনা না থাকলেও সংক্রমণ বেড়েছে। মঙ্গলবার রামেক হাসপাতালের দৈনন্দিন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী সর্বশেষ সোমবার (১৭ জানুয়ারি) রাজশাহীতে থাকা দুটি আরটি-পিসিআর ল্যাবে মোট ৪২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরা সকলেই রাজশাহী জেলার অধিবাসী। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে বর্তমানে রাজশাহী জেলায় করোনা শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা আগের সপ্তাহের সংক্রমণের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।
এ হাসপাতালের দৈনন্দিন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী এখানকার করোনা ইউনিটে থাকা ১০৪ শয্যার বিপরীতে মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল ৮টা পর্যন্ত ৩০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে রাজশাহী জেলার ১৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৬, নওগাঁর ৩, নাটোরের ১ এবং পাবনার ২ জন রোগী রয়েছে। এই ৩০ জনের মধ্যে করোনা পজিটিভ রোগী আছেন ১৬ জন। আর রোগটির উপসর্গ রয়েছে ৮ জনের। এ ছাড়া করোনা শনাক্ত হয়নি এমন রোগী আছেন ৬ জন।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাবেরা-গুল-নাহার বলেন, রাজশাহীতে এখনও করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন শনাক্তের সুযোগ নেই। আরটি-পিসিআর ল্যাবে কেবল করোনা পজিটিভ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তাই করোনা পজিটিভ শনাক্তকৃতরা ওমিক্রন আক্রান্ত কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সারা দেশের মধ্যে একমাত্র ঢাকার জাতীয় রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে (আইইডিসিআর) রেনডোমাইজ ফ্রিকুয়েন্স করে ওমিক্রন শনাক্ত করা হচ্ছে। এজন্য রাজশাহীর কিছু নমুনা সেখানে নিয়মিতভাবে পাঠানো হবে। এই প্রক্রিয়া কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হবে।
সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) নাজমা আক্তার জানান, হঠাৎ করে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। আর বিভাগের মধ্যে আবার রাজশাহী জেলাতেই করোনার সংক্রমণ বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণে এখন সকলকেই সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করতে হবে। আর মাস্ক পরাসহ সরকারি নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরাসহ সরকারি নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মানার আহবান জানিয়ে রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, জেলায় করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। তবে এটি করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রনের প্রভাবে হচ্ছে কি না এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা নয়টি উপজেলার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রেখেছি। এছাড়াও রাজশাহীর সদর হাসপাতালকে ১৫০ শয্যা ও ১৫ আইসিইউ সংবলিত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে প্রস্তুতের সংস্কার কাজ শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া রামেক হাসপাতালে চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে।
এদিকে, সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী রাজশাহীতে এ পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৮ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৮৫ জন। আর সিনোফার্ম টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৮ লাখ ৪৯ হাজার ৬০৬ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৫ লাখ ২ হাজার ৩৩৪ জন। এছাড়াও মডার্নার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ২ লাখ ২ হাজার ১৩৫ জন। ফাইজার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৪২ হাজার ৮২৯ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ হাজার ৬০৬ জন। বর্তমানে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বুস্টার ডোজ দেয়া হচ্ছে।
করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই সংক্রমিত হয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফর উল্লাহ ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিলসহ প্রায় এখানকার প্রায় দশ শীর্ষ ব্যক্তি। যে তালিকায় রয়েছেন ২য় বারের মত আক্রান্ত হওয়া দুইজন সংসদ সদস্যও। এরা হলেন, রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) প্রকৌশলী এনামুল হক এবং রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের আয়েন উদ্দিন এমপি। এছাড়াও আক্রান্ত হয়েছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনারসহ তাঁর দপ্তরের একাধিক ডেপুটি কমিশনারসহ একাধিক কর্মকর্তা। তবে শারীরিকভাবে সকলেই সুস্থ আছেন এবং বর্তমানে চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁরা নিজ নিজ বাসাতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।