সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় একাধিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কোনোভাবেই যেন এই মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যাচ্ছে না। যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেওয়া তথ্যে জানা যায়, সারা দেশে গত বছর ৫ হাজার ৬২৯টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৮০৯ জন। পরিবহণগুলোর রাস্তায় অশুভ প্রতিযোগীতায়ও প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ১২ বছরের রাকিব যে সংসারের হাল ফেরাতে হকার জীবন বেছে নিয়েছিল তাকে এই প্রতিযোগীতায় প্রাণ দিতে হয়েছে। জানা যায়, গত সাত বছরে ৩৭ হাজার ৪২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় অর্ধ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। যার বেশিরভাগই পথচারী। সে হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনাও এক ধরনের মহামারী যা চাইলেও রোধ করা যাচ্ছে না। ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। নতুন বছরের প্রথম মাসেই বহু মানুষ সড়কে প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া হিসাবে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন। যা তার আগের বছর ছিল ৭ হাজার ২২১ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্য ছিল ৭ হাজার ৩৯৭ জন এবং ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৫৫ জন। এই চিত্র থেকে ষ্পষ্ট হয় যে সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এর সমাধান কি? কিভাবে এই প্রাণগুলো রক্ষা করা যায়? কেউ তো চায় না এরকম অনাকাঙ্খিত প্রাণহানি ঘটুক। তারপরেও ঘটছে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। পরিবহনগুলো বেপোরয়া গতি, ওভারটেকিং প্রবণতা, গাড়ি চালানোর সময় কানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা,পথচারীর অসতর্কতা,অদক্ষতাসহ বিভিন্ন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা যাচ্ছে না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কতৃপক্ষও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মহাসড়কেও ফোর লেনসহ উন্নত হয়েছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। আমাদের দেশে যারা মহাসড়কে বা অন্যান্য সড়কে যানবাহন চালায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত। গাড়ি চালানোর সঠিক সাইড, গতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে না বললেই চলে। আবার জানলেও আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে তার মার প্যাঁচে ঠিক নিজেকে বের করে নেয়। চালকের ভুলেই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার হার বেশি থাকে। দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই! সড়ক দুর্ঘটনা শব্দটি বর্তমানে আমাদের এত বেশী শুনতে হয় যে বিষয়টা খুব বেশিক্ষণ মাথার মধ্যে থাকে না। দুর্ঘটনা শব্দটি দিয়েই প্রতিটি ঘটনাকে দাড় করানো হচ্ছে। কিন্তু কতদিন? এভাবে দায়িত্বে অবহেলাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। প্রতিদিন এবেলা ওবেলা যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কথা আমাদের কানে তাতে কোন দুর্ঘটনার কথা কতক্ষণ মনে থাকবে। আমাদের অনুভূতিগুলো মনে হয় অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। ইন্দ্রিয়গুলো এত সহজে আবেগে আক্রান্ত হয় না। কান্নার শক্তিও কমে গেছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বাস, ট্রাক, নসিমন-করিমন বা মটরসাইকেল বা কোন না কোন যানবাহন দুর্ঘটনায় পরবে। ইদানিং আবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকহারে। কখনো আলাদা আলাদা পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর খবর আসে আবার কখনো আসে একই পরিবারের সদস্যের মারা যাওয়ার খবর। ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিতে মানুষের মৃত্যু আর আগের মত ভাবায় না। শুধু সাময়িক এক ধরনের যন্ত্রণা দেয়। যে যন্ত্রণায় মিশে থাকে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুজে না পাওয়ার ব্যার্থতার কথা। বারবার বহু আলোচনা, যুক্তি,তর্ক, বহু লেখালেখি বহু টকশো হয়েছে এই সড়ক দুর্ঘটনার উপর। কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে।
আমরা সচরাচর যে কারণগুলো দেখি এসব কারণের মধ্যে রয়েছে ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের অদক্ষতা (অনেক সময়ই দেখা যায় কয়েকনি চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার পরপরই গাড়ি চালানোর মত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব তুলে নেয়), ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালনা করা ( আমাদের দেশে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন রাস্তায় কত গতিতে গাড়ি চালানো উচিত সেসব নিয়ম কানুন মেনে চলার কোন বালাই নেই। যদিও সড়কের ধারেই সর্বোচ্চ গতির বিষয়টি লেখা থাকে), মহাসড়কগুলোতে আগে চালানোর প্রবণতা (সামনের গাড়ির চেয়ে আগে না গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে না অথবা নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা অথবা অভ্যাসবশত অনেক চালকই এটা করে থাকে। জবাবদিহিতার অভাব, অনেক সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বেশী থাকে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া অর্থ্যাৎ আইন জানা সত্তেও দেখা যায় তা মেনে চলার কোনই প্রয়োজন মনে করে না অনেকে, ড্রাইভিং পেশার অনুৎকর্ষতা, ক্রটিপূর্ণ ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা, বিকল্প যানবাহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা।
আইন করা হয় নাগরিক সুরক্ষার জন্য। আর সে আইন মেনে চলা প্রতিটি নারিকের নৈতিক দায়িত্ব। আমি যদি মনে করি আমি না মানলে কিছুই হবে না অন্য সবাই মানবে। সেটা ভুল। কারণ আমাকে দিয়েই শুরু করতে হবে। নিজে মানতে হবে অন্যকে মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে কেন আইন মেনে রাস্তায় চলাচল করা উচিত। আমরা কেউই নিয়মের বাইরে যেতে পারি না। ঢাকা শহরে ওভারব্রীজ থাকতেও মারাত্বক ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছে প্রতিদিন। একটু এদিক সেদিক হলে যে রক্ষা নেই তাও কিন্তু জানি। এই কাজ যে ঠিক না এটাও কিন্তু জানি। কিন্তু মানি না। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর সাময়িকভাবে বোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় কাল থেকে এটা আর করবো না। কিন্তু কাল আসার পর আর মনে থাকে না। আবার সেই পুর্বদিনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করেই বাড়ি ফিরি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কিন্তু আমরা প্রায় সবাই জানি। সড়ক মহাসড়কে ক্রটি ও বিপদজনক মোড়গুলো কমিয়ে আনা, লাইসেন্সবিহীন সহকারীদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা, আইনের আধুনিকায়ন করা ইত্যাদি অনেক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে। তবে সব কথার বড় কথা নিজেকে তৈরি করা। যাত্রী হিসেবে আমি যেমন রাস্তায় চলাচলের আইন মানতে বাধ্য ঠিক তেমনি একজন চালক হিসেবেও যেন কেউ আইন সঠিকভাবে মেনে চলে। উন্নত বিশ্ব যদি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন? দুর্ঘটনা ঘটার পর কার দোষ ছিল কার দোষ ছিল না এসব না ভেবে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা চিন্তা করাই ভাল। কারণ দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই দায় আর কেউ নিতে চায় না। চালকদের প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। নতুন আইন দুর্ঘটনা রোধে কতটা সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনের পাশাপাশি নিজেদের আইন মেনে চলার অভ্যাসটাও করতে হবে।
গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। এক্ষেত্রেও যে দোষ কেবল চালকের এমন নয়। আমরা যারা পথচারী তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। রাজধানীতে নিয়ম না মেনে চলার প্রবণতাই বেশি। নানাভাবে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। এতকিছুর পরে সড়কে মড়ক থামছে না। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কে মারা যাচ্ছে মানুষ। কোন সংক্রামক রোগে নয় সড়কে দুর্ঘটনায় দেশে মড়ক লেগেছে। এর কোন প্রতিষেধক নেই। আমরা যদি একটু নিয়ম মেনে চলি এবং আইনের ব্যাবহার কার্যকর হয় তাহলে এই মড়ক আমরা অবশ্যই রোধ করতে পারবো। ইউনাইটেড ন্যাশনাল ডিকেট অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০১১-২০২০ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দক্ষ চালক প্রয়োজন। সবার মঙ্গলের জন্য আমাদের এই প্রাণহানি রোধে সব পক্ষকেই সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক