উপকুলীয় জনপদ কয়রার মানুষ প্রতিনিয়ত নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব সময় লেগেই আছে। তার পরেও টিকে থাকার লড়াই করে বেঁেচ আছে শত প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে নদী পাড়ের মানুষ গুলো। সম্প্রতি নদ-নদীর নাব্য হ্রাসে ধেয়ে আসছে লোনা পানি। লোনা পানিতে গ্রাস করছে আবাদি জমি, গাছপালা ও ঘরবাড়ি। নষ্ট করছে পরিবেশ। বিস্তীর্ণ এলাকা চোখের সামনে হচ্ছে বিরাণভূমি। এই চিত্র খুলনার কয়রা সহ উপকুলীয় এলাকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে চলছে মানবসৃষ্ট চিংড়ি ঘেরের দুর্যোগ। চিংড়ি ঘের মালিকরা লোনা পানি ঢুকিয়ে আবাদি জমি নষ্ট করে ঘেরের আওতায় নিয়ে আসে। তারপর একসময় জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে কৃষকের। এভাবে ঘের ব্যবসা বাড়ছে। কমছে আবাদি জমি। কৃষক হচ্ছেন ভুমিহীন। লেখালেখি হয় কিন্তু জোরালো বাদ-প্রতিবাদ নেই। বরং ঘের মালিকদের লাগামহীন দাপটে জমির মালিকরা থাকেন ভীত-সন্ত্রাস্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই তার উপর মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হয়েছে উপকুলবাসির নিত্যসঙ্গী। উপকুলে নির্মিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেড়ী বাঁধ প্রায়ই ভেঙ্গে লোনাপানি ঢোকে। ভেড়ী বাঁধ ছিদ্র করে পাইপে ঘেরে লোনাপানি ঢুকানোর রমরমা ব্যবসা করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা।
প্রতি বছর কোন না কোন সময় নদী ভেঙ্গে কয়রা যে কোন এলাকা প্লাবিত হয়ে থাকে। শুধু কয়রা নয় এরকম ঘটনা প্রায় ঘটে উপকুলীয় এলাকায়। ঘেরের কারণে সাতক্ষীরা. শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, তালা, বাগেরহাট, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা সহ উপকুলের হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি যা চাষীদের বেঁচে থাকার অবলম্বন তা ধ্বংস করা হয়েছে। লবনাক্ত এলাকায় সবুজের চিহ্ন নেই, শ্যাওলাও পচে কালো হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ উপকুলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। সরেজমিনে কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, আবাদি জমির এলাকা কমছে। বাড়ছে ঘেরের সংখ্যা। ঘেরের পাশের বহু আবাদি জমিতে চাষাবাদ হয় না বললেই চলে। এলাকায় একটি বাস্তব চিত্র রাস্তার এক পাশে সবুজঘেরা মাঠ আরেকপাশে লবণাক্তায় গ্রাস করা বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠ। যেসব কৃষকের ২/১ বিঘা জমি ছিল, আবাদ করে বছরের খাদ্য চাহিদা পুরণ করতেন, তারা আজ ভিন্ন পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন ঘের মালিকদের কারণে। মাঠের পর মাঠ লোনা পানি ঢুকিয়ে একরকম জমি দখল করে নেয়া হয়েছে। মিঠা পানির অভাবে মাঠের পর মাঠ আবাদি জমি থাকছে অনাবাদী। কয়রর অনেক চাষীরা জানালেন, ঘের মালিকরা নানা কৌশলে ও জোরজবর দস্তি ঢালাওভাবে আবাদি জমি দখল করছে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে। কেউ রুখে দাঁড়ালে তাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানী করা হয়। তাদের কথা দখলের পর দখলে আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। যা একটু জমি আছে তাতে চাষাবাদ করে বাঁচার চেষ্টা করছি, তাও সর্বনাশ হচ্ছে লবনাক্ততায়। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, চোখের সামনে সর্বনাশ দেখছি, কিছুই বলতে পারছি না। লোনা পানির কারণে ধানের চারা লাল হয়ে যায়। অন্য কোন আবাদও করতে পারি না। উপজেলঅর অধিকাংশ এলাকা বিরাজ করছে একই অবস্থা। অভিনব সব পন্থায় লোনা পানি ঢুকিয়ে একপর্যায়ে পানির দামে আবাদি জমি ক্রয় করে চিংড়ি ঘের করা হয়। কয়রার অনেক এলাকায় স্লুইচ গেট দিয়ে লোনা পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকার আবাদি জমি নষ্ট হয়েছে। ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট লবন সহিঞ্চু জাত আবিষ্কার করে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিকই। কিন্তু তা জোরদার নয়। কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের কথা, মৎস্য জোন হিসেবে চিহ্নিত চিংড়ি ঘের এলাকায় লবন পানিতে মাছ চাষ হোক, তাতে কোন চাষী বিরোধীতা করবে না। কিন্তু চিংড়ি ঘেরের কারণে আবাদি জমি বিরাণভুমিতে পরিণত হবে এটি মেনে নেয়া যায় না।
খুলনার সব চেয়ে কয়রা এলাকার চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপজেলা বাসি একরকম যুদ্ধ তরে টিকে আছেন। কয়রা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের চারপাশে ভেড়ীবাঁধ। ইউনিয়নগুলোতে প্রায় ৮ হাজার ঘের রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩/১ ও ১৪/২ পোল্ডার দিয়ে লোনা পানি ঢুকানো সম্পূর্ণ নিষেধ। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে লোনা পানি ঢুকাচ্ছে মৎস্য চাষিরা। এলাকায় রীতিমতো লোনা পানি ব্যবসা চলছে। এর কারণে উপকুলীয় অঞ্চলের বহু চাষী ভূমিহীন হয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। শুধু উপুকলীয় অঞ্চলেই নয়, ইতোমধ্যে খুলনার পাশ্ববর্তি জেলার বিভিন্ন এলাকায় লবণাক্ততা এমনিতেই ধেয়ে আসছে। দিনে দিনে এর মাত্রা বহুরুপে বৃদ্ধি পাচ্ছে।