ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বৃষ্টি আসাকে চা বাগানে বলা হয় ‘গোল্ডেন শাওয়ার’। এই সময়ের বৃষ্টি চা সংশ্লিষ্টদের জন্য এক আনন্দময় প্রাপ্তি। প্রতি বছর এই গোল্ডেন শাওয়ারের দেখা না মিললেও কয়েক বছর পর আবারও হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার চা বাগানগুলোতে কয়েক দিনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল এই গোল্ডেন শাওয়ার। ফলে ফেব্রুয়ারিতেই পুরোদমে শুরু হবে নতুন চা মৌসুম। গত কয়েক মৌসুমে চা উৎপাদন শুরু হয়েছিল মধ্য মার্চে। আগাম মৌসুম শুরু হলে চায়ের গুণগত মানের পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও বাগানগুলোতে চায়ের মূল্য নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, আগাম বৃষ্টি চা শিল্পের জন্য আনন্দময় প্রাপ্তি। এই সময়ে প্রতিটি বৃষ্টির ফোটা যেন আল্লাহর রহমত। নতুন কুঁড়ি গজানো ও চা চারা সুরক্ষার জন্য এই বৃষ্টি আশীর্বাদ স্বরূপ। এই বৃষ্টির ফলে চায়ের কুঁড়ি সতেজ ও পুষ্ট হবে এবং চায়ের চারা সতেজ হবে। রোগ বালাই থেকে অনেকটা সুরক্ষা করবে। চায়ের গুণগত মানও ভাল হবে। কয়েক মৌসুম পর এবার গোল্ডেন শাওয়ারের দেখা মিলেছে। যে বছরই গোল্ডেন শাওয়ার বা মাঘ মাসের বৃষ্টির দেখা মেলে সেই মৌসুমেই উৎপাদনও হয় বেশী। চা বাগানগুলোতে স্প্রুনিং শেষে সবাই বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিল। এই বৃষ্টি আসায় এখন চা বাগানগুলো উৎপাদন শুরু করতে পারবে। এবছর যদি আবহাওয়া বিরুপ না হয় তাহলে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কোন বৃষ্টিই হয়নি। এবছর জানুয়ারি মাসেও বৃষ্টি হয় এবং গত কয়েক ২ মিলিমিটারের বেশী বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টিতে সব্জির কিছুটা ক্ষতি হলেও বোরো ধান ও চায়ের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ।
মাধবপুর উপজেলার উপজেলার ন্যাশনাল টি কোম্পানি এনটিআরসির মালিকানাধীন তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম জানান, আগাম বৃষ্টিতে এবার ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই উৎপাদনে যাবে তার বাগান। আগাম বৃষ্টি না হলে অনেক বাগানেই মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। আগাম বৃষ্টি চা গাছের জন্যও উপকারী। এপ্রিল মাসের দিকে যদি খড়া দেখা না দেয় তাহলে এবার রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হবে।
এদিকে ২০২১ সালে চায়ের উৎপাদন বাড়লেও আশংকাজনক ভাবে নিলামে চায়ের বিক্রয় মূল্য কমতে থাকায় বাগান সংশ্লিষ্টরা হতাশ। গত বছরের প্রথম দিকে নিলামে চায়ের প্রতি কেজি গড়ে ২শ টাকা হলেও শেষ দিকে নিলামে দাম উঠেছে ১৪০টাকা। ১কেজি চা উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ২শ টাকা। করোনা মহামারীর মধ্যে চায়ের অভ্যন্তরীন চাহিদা কমে যাওয়া, বিদেশে চায়ের রপ্তানী কমে যাওয়া ও চায়ের নতুন বাজার সৃষ্টি না হওয়ায় চায়ের দর কমেছে বলে বাগান সংশ্লিষ্টরা জানান। এছাড়াও চা শিল্পের জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে চোরাই পথে ভারত থেকে আসা নিম্নমানের চা।
২০২১সালে নোয়াপাড়া চা বাগানে চা উৎপাদন হয়েছে ৬লাখ ১২হাজার কেজি। ২০২০সালে চা উৎপাদন হয়েছিল ৫লাখ ৮০হাজার কেজি। ২০২১সালে বেশি চা উৎপাদন হলেও নিলাম বাজারে চায়ের ভাল দর না পাওয়ায় এ চা বাগানে লোকসান দিতে হচ্ছে। নোয়াপাড়া চাবাগানের ডেপুটি ম্যানাজার সোহাগ মাহমুদ বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চা বাগানে নিয়মিত শ্রমিকদের রেশন, তলব সহ যাবতীয় খরচ মেটানো হয়। নিলাম বাজারে বাগান উৎপাদিত চা বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ সহ অন্যান্য খরচ করা হয়। কিন্তু চায়ের দর কমে যাওয়ায় ব্যাংকের ঋণ সহ অন্যান্য খরচ বহন করা বাগানের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। মাধবপুর উপজেলার সুরমা চা বাগানে ২০২১সালে ১৪লাখ ৮ হাজার কেজি চা উৎপাদন করা হয়েছে। ২০২০সালে উৎপাদন করা হয়েছিল ১৩লাখ ৪৫হাজার কেজি। ২০২১সালে ৬৩হাজার কেজি চা বেশি উৎপাদিত হয়েছিল। উৎপাদন বেশি হলেও নিলামে বাজার দর এমন ভাল পাওয়া যায়নি। সুরমা চা বাগান ব্যবস্থাপক আবুল কাসেম জানান, গত ৪/৫বছর ধরে চায়ের ভাল দর পাওয়া যাচ্ছেনা। মহামারী করোনার মধ্যে চায়ের দর আরো কমেছে। বাজারে প্যাকেট জাত চা ৩শ থেকে ৫শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। অথচ নিলামে প্রতি কেজি চায়ের দর দেড়শ থেকে ২শ মধ্যে। বাগানে শ্রমিকের মজুরি, রেশন ও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে চায়ের বাজার দর বাড়ছে না।
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, ২০২১সালে এপ্রিল মে মাসে চা বাগানগুলো প্রচন্ড খরার মধ্যে পড়ে। এর পরও প্রতিকুল অবস্থা মোকাবেলা করে ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদন বেড়েছে অনেক গুন। সরকার যদি প্রতি কেজি চা কমপক্ষে আড়াইশ টাকা নির্ধারণ করে দিলে চা শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব। অন্যথায় প্রতি বছর লোকসানের মধ্যে পড়ে বাগানগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া করোনা মহামারীর মধ্যে সরকার সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ দিলে বাগানগুলো চলতে পারবে।