জাতীয় মাছ ইলিশ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরনের আড়ালে ঢাকা পরেছে হাজার হাজার জেলেদের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নটি। সংসারের ভরনপোষণের লক্ষ্যে অর্থ উপার্জনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পরে কেউ কেউ বাড়ি ফিরছে লাশ হয়ে। আবার কোন কোন জেলে বছরের পর বছর নিঁেখাজ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বয়ে চলা উত্তল সাগরে অরক্ষিত জীবন রক্ষায় স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।
বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক পেশা হচ্ছে সাগরে মাছ ধরা। প্রতি বছর সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পরে অসংখ্য ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। তখন শত শত জেলে নিখোঁজ হয়। ঐ সব জেলেরা কোষ্টগার্ড, বন বিভাগ ও নৌবাহিনী ও ফিশিং বোর্ডের জেলেদের সাহায্যে ভাসমান অবস্থায় জীবিত উদ্ধার হলেও কিছু জেলের উদ্ধার হয় লাশ। আবার কোনো কোনো নিখোঁজ হওয়া জেলেদের বছরের পর বছর পার হলেও আজও হদিস মেলেনি। তখন সেইসব জেলে পরিবার সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে নিশ্ব হয়ে পরে।
উন্নত বিশ্বে জেলেরা যদিও নিরাপত্তা সরঞ্জম ব্যবহার করে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু এ দেশে তার উল্টো। অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরনে নিয়োজিত ফিশিং বোর্ডের অধিকাংশ মালিকরা জেলেদের জীবনের ঝুঁকি বা নিরাপত্তা নিয়ে ভাবে না। জেলেদের স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জমের মধ্যে রয়েছে লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া, জিপিএস, কম্পাস, পর্যাপ্ত জালানি, বিকল্প নৌযান, টর্স লাইট, হুইসেল, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও প্রথমিক স্বাস্থ্য সেবার সরঞ্জাম (ফাস্ট এইট বক্স) ন্যুনতম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।
বাস্তবে জেলেদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কতটুকু দেয়া হয় তা পর্যবেক্ষণের জন্য শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারের মৎস্য বন্দর গিয়ে বিভিন্ন জেলে, মাঝি ও ফিশিং বোর্ড মালিকদের সাথে কথা বলা হয়। এ সময় ঘাটে প্রায় অর্ধশত ফিশিং বোর্ড নোঙর করা ছিল। তখন অধিকাংশ ট্রলারেই নিয়মানুযায়ী জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষাকারী সরঞ্জাম দেখা যায়নি।
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি মোঃ কামাল আহম্মেদ মানবকন্ঠকে বলেন, গত ৪ ফেব্রুয়ারী সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ২৫ ট্রলার ডুবির ঘটনায় ১২ জেলে নিখোজ হয়। তার মধ্যে সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়ছে। কোস্ট গার্ড, বনবিভাগ ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের যৌথ অভিযানে ৫ টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ব্যাপারে শরণখোলা থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ২ টি লাশ উদ্ধার করে জেলেরা। দীর্ঘ ৯ দিন উদ্ধার অভিযানের পর আমাদের উদ্ধার অভিযান শনিবার সমাপ্ত ঘোষনা করা হয়েছে। তবে কোষ্টগার্ডের উদ্ধার অভিযান অব্যহত রয়েছে। এখন কোনো লাস পাওয়া গেলেও তার চেহারা বিকৃত হয়েছে। তাদের পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আগামী সিজনে কোন ফিশিং বোর্ডের জেলেরা লাইফ জ্যাকেট, বয়া ও জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম ছাড়া কেউ সাগরে যেতে পারবে না। ফিশারম্যান গ্রুপের পক্ষ থেকে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন ঘূর্ণিঝড় হলে জেলেরা জানতে পারে কিন্তু অনেক সময় টর্নেডো হলে জেলেরা জানতে পারে না। সে কারণে আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়।
সর্বশেষ খোজনিয়ে জানা যায়, উদ্ধারকৃত ইসমাইল বাড়ি মঠবাড়িয়ার জানখালী গ্রামে ও আলমগীর সর্দারের বাড়ি একই উপজেলার ছোট মাছুয়া গ্রামে। আনোয়ার হোসেন বাদল (৫০), রুহুল হাওলাদার (৪৫ ), শহিদুল মল্লিক (৪০), মুহিদ মোল্লা (৪০) এদের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বগা ও আন্ধারমানিক গ্রামে। চিতলমারী উপজেলার কালিগঞ্জ গ্রামের মামুন সেখ( ৪২)। এখনো ৫ জেলে নিখোজ রয়েছে। তারা হলো কচুয়ার বগা গ্রামের আবু বক্কর মোল্লা (৩২) ও বাবুল হাওলাদার (৪০) রামপালের শাহিন, মঠবাড়িয়ার জামিলা ট্রলারের জেলে মঠবাড়িয়ার ছোট মাছুয়া গ্রামের বাচ্চু মিয়া ( ৩৮)।
শরণখোলার এফবি রুপসার মাঝি শহিদুল ফরাজী বলেন তার ফিশিং বোর্ড ঝড়ের কবলে পড়ে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৭ জন জেলেসহ ডুবে যায়। প্রায় ৩ ঘন্টা ভেসে থাকার পর ভারতীয় জেলেরা উদ্ধার করে। একই উপজেলার এফবি মান্নান বোর্ডের মাঝি মান্নান জানায় তার বোর্ড ঝড়ের কবলে পড়ে ২০১৬ সালে ১৫ জন জেলে নিয়ে গভীর সাগরে ডুবে যায়। পরে অন্য ফিশিং বোর্ড ২/৩ ঘন্টা পরে তাদের উদ্ধার করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন জেলেদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার এবং জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জম বোর্ডে না থাকা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা চিন্তা করে ব্যবসা নিয়ে।
২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর শরণখোলার উত্তর কদমতলা গ্রামের বিলাশ রায় কালুর এফবি মুক্তি - ১ ফিশিং ট্রলারসহ ১৬ জন জেলে বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণ করতে গিয়ে নিখোজ হয়। সাত বছর পার হলেও আজও কোন সন্ধান মেলেনি। ট্রলার মালিক কালু জানায়, ধারদেনা করে তৈরী করা প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ফিশিং ট্রলার হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। পরিবারে কর্মক্ষম নিখোজ ১৬ জেলে পরিবারের সদস্যরা খেয়ে না খেয়ে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অপরদিকে ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামের ১৯ জেলে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়।
জানাযায়, গত তিন দশকে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে প্রায় দেড় হাজার জেলে প্রাণ হারিয়েছে। তাদের মধ্যে সুপার সাইক্লোন সিডরে ৩৫০ জন, ২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আকস্মিক ঝড়ে তিন শতাধিক ও ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে দুবলার চরে প্রায় ৫০০ জেলে প্রান হারায়।
বাংলাদেশ ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সহ সভাপতি আলহাজ্ব সাইফুল ইসলাম খোকন বলেন সামুদ্রিক ফিশিং বোর্ডে জেলেদের জীবন রক্ষায় নামমাত্র ২/৪ টি লাইফ বয়া থাকলেও বোট মালিকদের উদাসীনতায় লাইফ জ্যাকেট রাখা হয় না। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএস এম রাসেল বলেন সামুদ্রগামী ফিশিং বোর্ডে জেলেদের জীবন রক্ষায় লাইফ বয়া ও লাইফ জ্যাকেট রাখা বাধ্যতামূলক। এটা তদরকীর দায়িত্ব সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের। কিন্তু বাগেরহাট সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর নেই। এ দপ্তর করার জন্য শরণখোলায় জায়গা খোঁজা হচ্ছে। আগামী এক বছরের মধ্যে এ দপ্তরের কার্যক্রম শুরু হবে বলে তিনি জানান।