ইমরান হোসেনের বয়স তখন মাত্র ১২ মাস। সংসারে মা-বাবার কলহ লেগেই থাকতো। এর অল্প দিনের মধ্যে ঘটে বিচ্ছেদ। জন্মের পর ওই কটা মাস বাবার সান্নিধ্য পেয়েছে ইমরান।
বাবা ও মায়ের বিচ্ছেদের কারণে মায়ের সাথে ইমরানের ঠাঁই হয় নানা বাড়িতে। প্রায় দেড় বছর পর ইমরানের মাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হয়। আড়াই বছর বয়সে মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্ছিত হয় ইমরান।
মা ও বাবার আদর-যতœ ছাড়াই নানা বাড়িতে বড় হয় ইমরান। কৃষক নানার অভাব অনটনের সংসার। নতুন সদস্য আসায় খরচ বেড়ে যায়। দরিদ্র নানার ওপর চাঁপ কমাতে ছোট বয়সেই অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছে ইমরানকে। পাশাপাশি গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা চালিয়ে যায় ইমরান।
এতোসব প্রতিকূলতার মধ্যেও অদম্য ইচ্ছে আর নিরলস প্রচেষ্টায় চলতি বছর এসএসসি পাস করেছে ইমরান। কিন্তু একাদশ শ্রেনীতে ভর্তির জন্য আবেদন করতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। ইমরানের উচ্চশিক্ষার জন্য বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পিতার স্বীকৃতি।
কলেজ থেকে জানানো হয়েছে, তার জন্মসনদ জমা দিতে হবে। জন্মসনদ করতে গিয়ে ইমরান জানতে পারে বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) লাগবে। বাবার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চাইতে গেলে ইমরানকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করেন বাবা। একপর্যায়ে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেয়া হয় ইমরানকে। পিতৃপরিচয়ের জন্য ইমরান এখন ইউএনও, স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেরিয়েও কোন সুফল পাচ্ছেন না। ফলে কলেজে ভর্তি হওয়া আটকে গেছে পিতৃহীন ইমরানের।
সূত্রমতে, ইমরানের নানাবাড়ি জেলার হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল কাউরিয়া গ্রামে। নানা আলী আকবর কাজীর সংসারে তার বেড়ে ওঠা। ইমরানের বয়স এখন ২০ এর কাছাকাছি। জেএসসি এবং মাধ্যমিক সনদে বাবার নাম উল্লেখ রয়েছে দলিলুর রহমান। তিনি (দলিলুর) একই গ্রামের গফুর সরদারের ছেলে। ইমরানের নানা বাড়ি থেকে দলিলুর রহমানের বাড়ির দূরত্ব প্রায় পাঁচ মিনিটের। এত কাছাকাছি থেকেও বাবা বলে ডাকা বা বাবার আদর স্নেহ জোটেনি ইমরানের ভাগ্যে।
ইমরানের নানা আলী আকবর কাজী বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে তার মেয়ে আকলিমার সাথে বিয়ে হয় একই গ্রামের আবদুল গফুর সরদারের ছেলে দলিলুর রহমানের। কিন্তু সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় দলিলুর তার মেয়ে আকলিমাকে তালাক দেয়। এরপর দলিলুরের একমাত্র সন্তান ইমরানকে নিয়ে আকলিমা তার কাছে ছিলো।
তিনি আরও বলেন, সংসারে আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং আকলিমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আলমগীর হোসেন নামের শরীয়তপুরের এক যুবকের সাথে তার বিয়ে দেওয়া হয়। আকলিমা বর্তমানে কর্মস্থলের সুবাদে স্বামীসহ মরিশাসে রয়েছে।
গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ একাধিক বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গ্রামের সবাই জানেন দলিলুরের সন্তান ইমরান। কিন্তু দলিলুর ইমরানকে স্বীকৃতি দিচ্ছেনা। ইমরান জানায়, বাবা-মায়ের আদর স্নেহ কী বলতে পারবো না। তবে তাদের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই। নানার সংসারে বড় হয়েছি। নানার বয়স হয়েছে। এখন কাজ করতে পারেন না। তাই ইচ্ছে লেখাপড়া শিখে একটি চাকরি পেলে নানাকে আর আমার খরচ বহন করতে হবেনা। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য ঢাকার সাভারে আলহাজ¦ আবদুল মান্নান কলেজে আবেদন করেছি। কলেজ থেকে জানানো হয়েছে, জন্মসনদ জমা দিতে হবে। জন্মসনদ করতে গিয়ে জানতে পারি পিতার জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। বাবার কাছে (দলিলুর রহমান) পরিচয়পত্রের ফটোকপি চাইতে গেলে তিনি দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর ইউএনও, স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ বিভিন্নজনের কাছে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পাইনি।
ইমরান আরও জানায়, বাবা ও দাদাকে রাস্তায় ধরে অনেকবার আকুতি-মিনতি করেছি। কিন্তু তাদের মন গলেনি। বাবার কাছে আমার সহায় সম্পদের চাওয়ার নেই। তিনি আমাকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেবেন, সেটাই আমার চাওয়া।
গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য জয়নাল হোসেন বলেন, গ্রামের সবাই জানেন দলিলুর রহমানের সন্তান ইমরান। ইমরানের সমস্যা সমাধানে এনআইডির ফটোকপির জন্য আমি দলিলুর রহমানের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে এনআইডির ফটোকপি দিতে রাজি নন।
গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ শাহাজাহান বলেন, ইমরানের অসহায়ত্ব দেখে আমি নিজে দলিলুর রহমানের কাছে গিয়েছিলাম। তবে দলিলুরের কঠোরতা দেখে সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।
ইমরান এসএসসি পাস করেছে গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের মাউলতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে। বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক মোবারক হোসেন বলেন, ইমরানের কলেজে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে এসএসসি পাস পর্যন্ত সব শিক্ষা সনদে পিতার নাম দলিলুর রহমান উল্লেখ রয়েছে। কলেজে ভর্তি হতে হলে জন্মসনদ করতে দলিলুর রহমানের পরিচয়পত্রের কপি লাগবে। বিদ্যালয় থেকে দলিলুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়েছি।
দলিলুর রহমান জানান, আকলিমার চরিত্র ভালো ছিলোনা। ইমরান নামের ওই সন্তান আমার না। ২০ বছর আগে গ্রামের একটি মহল ষড়যন্ত্র করে আমাকে অন্তঃস্বত্তা আকলিমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। তার সাথে আমার শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়নি। বিয়ের তিনমাস পর তাকে তালাক দিয়েছি।
দলিলুর রহমান আরও বলেন, তিনি আরেকটি বিয়ে করে তিন সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছেন। জ¦ালানি তেলের ব্যবসায় তার সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। এলাকায় কিছু জমিও কিনেছেন। কিন্তু সেই সম্পদের ওপর ষড়যন্ত্রকারীদের নজর পরেছে। জমি ও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতে তারা নতুন করে চক্রান্ত করছে।
হিজলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বকুল চন্দ্র কবিরাজ বলেন, অতিসম্প্রতি ইমরান আমার কাছে এসে তার ঘটনা বলেছে। এরপর আমি বিষয়টি সমাধানের জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছিলাম। চেয়ারম্যান ব্যর্থ হলে আমি নিজেই দলিলুর রহমানের সাথে কথা বলেছি। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তার কারণে ইমরানের উচ্চশিক্ষা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে দলিলুর রহমান এ বিষয়ে তার কিছু করার নেই বলে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এখন পিতৃপরিচয় ও স্বীকৃতির দাবিতে ইমরানের আইনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া অন্যকোনো পথ নেই।