মজুরি বৈষম্যের শিকার শেরপুরে নারী শ্রমিকরা। রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ও মানুষের নেতিবাচক কথা পরও পরিবারের দিকে তাকিয়ে বছরের পর বছর বিভিন্ন খাতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু একজন পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেও সমান বেতন পান না নারী শ্রমিকরা। প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। নারী নেত্রীরা জানিয়েছেন, বছর ঘুরে নারী দিবস আসে আর তখন নারী শ্রমিকদের মজুরি-বৈষম্যের শিকার হওয়ার বিষয়টি সামনে আসলেও তাদের মজুরির কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই নারীর অধিকার, মজুরিসহ নানা বিষয়ে সমঅধিকার নিশ্চিত প্রয়োজন। জানা যায়, শেরপুর জেলাজুড়ে ইটভাটায়, কৃষিকাজ, গৃহশ্রম, মাটি কাটা, নির্মাণ খাত ও চাতালের কাজসহ বিভিন্ন কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা। কিন্তু নারীরা কখনোই পুরুষের সমান মজুরি পান না। একজন পুরুষ যদি সারাদিন কাজ করে পান ৫০০ টাকা, সমান সময় কাজ করে একজন নারী শ্রমিক পান ২০০ থেকে ২৫০টাকা। ফলে প্রতিটি জায়গায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে নিম্নআয়ের নারী শ্রমিকরা আরও বেশি এই বৈষম্যের শিকার। দেখা গেছে- একসময় যারা ঝিয়ের কাজ করতেন, এখন তারা মাঠে-ঘাটে কাজ করছেন। অনেকেই আবার পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন। শেরপুর সদর, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নারী শ্রমিকরা ধানের চারা রোপণ ও পরিচর্যা, পাথর ভাঙা, চাতাল কল, ইটভাটা ও মাটি কাটার কাজসহ বিভিন্ন কাজ করছেন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করলে এক দিনের কাজ ধরা হয়। এই একদিনের বেতন একজন পুরুষ শ্রমিক পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ হিসাবে একজন নারী শ্রমিকের সমান বেতন পাওয়ার কথা। কিন্তু একজন নারী শ্রমিক পাচ্ছেন ১৫০টাকা থেকে ২০০ টাকা। কর্মক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকরা যেখানে মোট কর্মঘণ্টার (একদিন) এক থেকে দেড় ঘণ্টা কম কাজ করেন, সেখানে নারী শ্রমিকরা খাওয়ার সময় বাদে বিশ্রামের সুযোগও পান না। ছোট ছোট বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বহু নারী শ্রমিকদের কাজ করতে দেখা গেছে। এমনকি নারীরা নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে অতিরিক্ত কাজ করলেও তার মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রতিদিনই পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে কাজে অংশ নিচ্ছেন নারী শ্রমিকরা, কিন্তু তারা মজুরি সমান পাচ্ছেন না। পরিবারের ক্ষুধা নিবারণে বৈষম্য উপেক্ষা করে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। অসুস্থ হলে কিংবা কাজে একটু ত্রুটি হলে বেতন কাটা থেকে শুরু করে কাজ হারাতে হচ্ছে তাদের। শেরপুর সদরের চাতাল কলে কাজ করা শ্রমিক সরুফা বেগম বলেন, ‘আমরা-তো মইরি গেছি, টেহা পয়সে কম দে মালিকরা। গরীব মানুষ তাই কম টেহা দিয়েই কাজ করি। মালিকদের কাছে টেহা বেশি চাইলে কাজে আবার না করে। এজন্য যা পাই তা দিয়ে কোনো মতে সংসারে হাল ধরি।’ সদরের একটি ইটভাটার শ্রমিক আছমা বেগম বলেন, ‘পুরুষের চাইতে টাকা আমাদের কম দেয়, যদি সরদারকে বলি টাকা কম কেন, তখন সরদার বলে কালকে থেকে যেন ভাটায় না আসি, এজন্য কিছু বলি না। যা দেয়, তাই নেই।’ ঝিনাইগাতী উপজেলার দুধনই গ্রামের মাটি কাটার শ্রমিক হনুফা বেগম বলেন, ‘আমি সকাল ৭টার সময় মাটি কাটতে যাই, বিকাল ৫টা পর্যন্ত মাটি কাটি। আমার বেতন পুরুষের চেয়ে কম। কাজ সমান করি কিন্তু মালিকরা টাকা কম দেয়। আমি গরীব মানুষ, তাই ওই টাকাই নেই, না নিলে খামু কি, চলমু কি করে, সন্তান আছে।’ ঝিনাইগাতী উপজেলার পানবর গ্রামের মাটি কাটার শ্রমিক সালমা বেগম বলেন, ‘আমরা সকাল সাতটাই আসি, সারাদিন কাজ করি, মাটি কোপানো, মাটি বাইরানো, আবার খাঁচা দিয়ে অন্য জায়গায় ফেলানো। এইভাবে কাজ করার পর বিকাল পাঁচটায় আমাদের ছুটি হয়। সারাদিনে কাজ করে আমরা ২০০ টাকা পাই। আর পুরুষ মানুষরা সারাদিনে কাজ করলে ৫০০- ৬০০ টাকা পায়। এখন জিনিসপাতির যে দাম হইছে। যে টাকা বেতন পাই কোনো কিছুই কিনা যায় না।’ নারী নেত্রীদের অভিযোগ, শেরপুরে এখনো নারী-পুরুষদের বৈষম্য দূর হয়নি। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন খাতে নারীরা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একজন পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেও সমান বেতন পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ শেরপুর জেলা শাখার সভানেত্রী জয়শ্রী দাস লক্ষ্মী বলেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, পদায়নও হয়েছে, নারী-পুরুষ সমন্বয়ে কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়েও যাচ্ছে। নারীরা আন্তরিকতার সাথে কাজ করেন, তারা কাজে ফাঁকি দেন না। কিন্তু তাদের মজুরি বৈষম্য এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমি সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি জানাই যেন এই মজুরি বৈষম্য দূর হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা চেয়ারম্যান নাসরিন রহমান বলেন, একজন পুরুষের সমান কাজ করেও একজন নারী সমান বেতন পান না। এটা খুবই দুঃখজনক। দীর্ঘদিন এমন অবস্থা থাকলেও শুরু বিশ্ব নারী দিবসে বিষয়টি সামনে আসে। যাই হোক আমরা চাই, এ ধরণের মানসিকতা থেকে সমাজ মুক্তি পাক। সমাজে নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্য দূর হয়ে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হোক সেই প্রত্যাশা করি।