শেরপুরের নকলায় তেলবীজ ফসল সূর্যমুখী চাষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সূর্যমুখীতে শতাংশে আয় হচ্ছে কমপক্ষে ২ হাজার ৫০০ টাকা। নামমাত্র শ্রমে ও স্বল্প ব্যয়ে বাড়তি আয় সম্ভব সূর্যমুখী চাষে।
নকলা উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া সূর্যমুখী চাষাবাদের জন্য বেশ উপযোগী। কম সময় ও অল্প ব্যয়ে সূর্যমুখী চাষ করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কৃষি বিভাগ কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পরীক্ষামূলকভাবে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তেলবীজ সূর্যমুখী আবাদ শুরু করেছে গত কয়েক বছর থেকেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে সূর্যমুখী ফুলের চাষ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
গত বছর উপজেলার পাঠাকাটা, চন্দ্রকোনা ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নের ৭ একর পতিত জমিতে প্রণোদনার মাধ্যমে সূর্যমুখী চাষের আওতায় আনা হয়। ওই বছর ২০ কৃষককে দেওয়া হয় সূর্যমুখী চাষের কৃষি প্রণোদনা। এতে কৃষকরা লাভবান হওয়ায় অন্যান্য কৃষকরা আগ্রহী হয়েছেন। এ ফসল চাষ করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন, ফলে সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান।
এ বছর নকলা উপজেলায় কৃষি বিভাগের সহায়তায় ৩ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করেছেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের তেল ফসল প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। উপজেলার বানেশ্বরদী, চন্দ্রকোনা, পাঠাকাটা, টালকী ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নের অনেক কৃষক নিজ উদ্যোগে ও কৃষি বিভাগের পরামর্শে তেলবীজ ফসল সূর্যমুখী চাষ করেছেন। এ ছাড়া অনেকে বাড়ির আঙিনায় ও অফিসের সামনে শখের বসে সূর্যমুখী ফুল হিসেবে চাষ করেছেন। এটি স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করা সহজ নাহলেও দামি ফসল হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।
ভোজ্যতেলের মধ্যে সূর্যমুখীর তেল মানব শরীরের জন্য খুব উপকারী। সূর্যমুখীর আবাদ কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে উপজেলা কৃষি বিভাগের সহায়তায় পরীক্ষামূলক ভাবে ৩ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করা হয়েছে। এসব জমিতে সূর্যমুখীর বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলন দেখে অন্যান্য কৃষকরা তাদের পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষের দিকে ঝুঁকছেন। সেই সাথে উপজেলার বিভিন্ন বাড়ির আঙ্গিনাসহ পতিত জমিতে আরো অন্তত ২ থেকে ৩ হেক্টর জমিতে এ তেলবীজ ফসলের চাষ সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে করা হয়েছে। এসব সূর্যমুখীর ফুলের সৌন্দর্য দেখতে এসে অনেক দর্শনার্থী এ ফসল চাষ করার পদ্ধতিও শিখছেন বলে চাষীরা জানান।
নকলা উপজেলার বানেশ্বরদী ইউনিয়নের তেল ফসল উৎপাদনকারী কৃষক দলের সদস্য বানেশ্বরদী আড়িয়াকান্দা এলাকার কৃষক আফজাল হোসেন জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তেল জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্যাটার্ন ভিত্তিক একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে সূর্যমুখী-আউশ-রোপা আমন প্যাটার্নের আওতায় ৫০ শতাংশ জমিতে হাইসান-৩ জাতের সূর্যমুখী চাষ করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টাকা। তবে কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনা হিসেবে ২ কেজি বীজ ও কিছু সার দেওয়া হয়েছে। বাম্পার ফলনে তার মুখে হাসি ফোটে ওঠেছে। তিনি আশা করছেন সূর্যমুখী-আউশ-রোপা আমন প্যাটার্নভুক্ত এই ৫০ শতাংশ জমির সূর্যমুখী থেকেই লক্ষাধিক টাকা আয় হবে। তবে স্থানীয়ভাবে চাহিদা ও বাজারজাতের ব্যবস্থা করতে পারলে তার ৫০ শতাংশ জমির সূর্যমুখী থেকে দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকা আয় হতো। তিনি বলেন, তার এই জমিতে আগে আমন ধান চাষ করা হয়েছিলো। এখন সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। এরপর রোপা আমন বা পাট রোপন করা হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ শেখ ফজলুল হক মনি ও কৃষিবিদ মো. মাহামুদুল হক মুসা জানান, এ ফসলের আবাদ করতে নভেম্বরের প্রথমার্ধে সারিবদ্ধভাবে বীজ বপন করা হয়। বীজ বপনের ৯০ দিন থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়। সামান্য পরিমাণ রাসায়নিক সার ও ২-৩ বার সেচ ছাড়া আর তেমন বড় কোন যতœ নিতে হয়না। সূর্যমুখী গাছ জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ তেলবীজ আবাদে ব্যয়ের তুলনায় কয়েকগুণ লাভ হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, সূর্যমুখীর তেল অন্যান্য তেলের চেয়ে বেশ আলাদা। কোলেস্টেরলমুক্ত সূর্যমুখীর তেলে প্রচুর পরিমাণ প্রাণশক্তি থাকায় এটি আমাদের শরীরের দুর্বলতা কমিয়ে কর্মক্ষমতা বাড়ায়। রান্নার জন্য সয়াবিন বা সরিষা তেলের চেয়ে সূর্যমুখীর তেল প্রায় ১০ গুণ বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। শরীর সুস্থ রাখতে ও হাড় মজবুত করতে সূর্যমুখী তেল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে বলে স্থানীয় পুষ্টিবিদরা জানান।
সূর্যমুখী তেলে থাকা ম্যাগনেসিয়াম আমাদের মানসিক চাপ দূর করে। এ তেল মানবদেহের জন্য অনেকটাই মহৌষধ হিসেবে ভূমিকা পালন করে বলে জানান নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা। তিনি আরও জানান, সূর্যমুখীর বীজ থেকে উৎপাদিত তেলে লিনোলিক অ্যাসিড থাকে, যা মানব হার্ট ভালো রাখতে ভুমিকা পালন করে। সূর্যমুখী তেলের উৎপাদন বাড়লে একদিকে মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত তেল পাবেন, অন্যদিকে লাভবান হবেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল ওয়াদুদ জানান, অন্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখীর চাষে খরচ কম, কিন্তু লাভ বেশি পাওয়া যায়। এতে ২-৩ বার সেচ ছাড়া তেমন সার ও কীটনাশক লাগেনা বললেই চলে। এ তেলবীজ চাষে বাড়তি তেমন পরিচর্যারও দরকার হয়না। তাছাড়া অন্যান্য তেলবীজের তুলনায় অনেক বেশি তেল পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে প্রতি বছর বিদেশ থেকে সূর্যমুখীর বীজ ও এর তেল আমদানি করতে হয়। দেশে সূর্যমুখী তেলবীজ ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করা গেলে আমদানি কমবে, পক্ষান্তরে বাড়বে কৃষি আয়।