যখন তনু হত্যার বিচার হয় না, বিচার বাস্তবায়ন হয় না নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার; তখন নির্মমভাবে আততায়ির গুলিতে মৃত্যু বরণ করে আওয়ামী লীগ নেতা টিপু-প্রীতি, ছুরিকাঘাতে ডাক্তার বুলবুল। এই সময়ে এসে বিশে^র বুকে দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম দেশের মানুষ হিসেবে বরাবরই গর্বিত হওয়ার পরিবর্তে লজ্জিত হই আমরা। এই লজ্জার নেপথ্য নায়ক আমাদের তথাকথিত ধর্মীয় নেতারা। যারা ধর্মকে কেবল নিজেদের রুটি-জীবন-জীবিকা আর পার্থিব আরাম আয়েশের রাস্তা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এরা ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।’-এর ভুল ব্যাখ্যা করে পড়াকে কেবল ধর্মীয় শিক্ষা বোঝায় আর ‘তোমারা তোমাদের চোখকে সংযত রাখো।’ কে ভুল ব্যাখা করে কেবল বোরকার দিকে ধাবিত করতে উঠে পরে লেগে আছে যুগের পর যুগ ধরে। অথচ ইসলাম সবসময়-ই আলোর পথে ভালোর পথে ছিলো-আছে-থাকবে; তা ভুলে গিয়ে নারীদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করে। কিন্তু একবারের জন্যেও ভাবে না, নারীর বোরকা তো দূরের কথা, বড় ওড়নাও প্রয়োজন হতো না, যদি আমরা পুরুষরা আল্লাহ তা’য়ালার উপর ইমান আনতে পারতাম। প্রকৃত ইমানদারার কখনোই কোন অন্যায় তো করবে না, ভাববেও না। তাছাড়া যার মধ্যে সামাণ্য আল্লাহর ভয় আছে, সে কখনোই কোন অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতি করতে পারে না। খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাস! সে তো কখনোই ভাববে না-ভাবতে পারবে না। যদি সত্যিকার্থেই মুসলাম, সত্যিকার্থেই ধর্মীয় অনুশাসন মানে। এখন তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে- ‘যারা খুন করে তারা কি মুসলমান নয়? যারা ধর্ষণ করে তারা কি মুসলমান নয়?’ অবশ্যই নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি প্রচুর পরিমাণ ওয়াজ-মাহফিল হচ্ছে, এরইমধ্যে হচ্ছে একের পর এক খুন-ধর্ষণও।
২০২১ সালে ১ হাজার ১১৭ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কলাম লিখেছিলাম। বলেছিলাম, ধর্ষণের জন্য আমাদের ইমানহীনতাই দায়ি। যদিও শত করা এখন ৪০ ভাগ বাঙালি এখন মাথায় টুপি পরে, সুন্নতি দাড়ি রাখে; কিন্তু তারা আল্লাহর উপর বিশ^াস-ই আনেনি; সমাজকে দেখানোর জন্য, এক কথায় ধোঁকা দেয়ার জন্য তারা মাথায় টুপি, পাগড়ি, দাড়ি, পাঞ্জাবির আশ্রয় নিলেও মনের ভেতর চরম অবিশ^াস নিয়ে জীবন নির্বাহ করে। এরা আল্লাহর উপর এতটাই বিশ^াসহীন যে, চালের-ডালের- তেলের এমনকি লবনের দাম বাড়লেও তা মজুদ করে ঘর ভরে রাখে। ভাবে- ‘পরে যদি না পাওয়া যায়, তখন তো না খেয়ে থাকতে হবে।’ কিন্তু ইসলাম বলছে- ‘আল্লাহই সবার আহারসহ সকল কিছুর নির্ধারক, তিনি প্রতিপালক।’ এই অবিশ^াসের হাত ধরেই ঘটছে অহরহ অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতি; বাড়ছে ধর্ষণ-খুনের মত ঘটনাও।
কেবলমাত্র সুশিক্ষা আর ধর্মীয় অনুশাসন থেকে সরে যাওয়ার কারণে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হওয়া সত্ত্বেও ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগণ বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালে এক হাজার ১১৭ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একক ৭২৩, দলবদ্ধ ১৫৫, প্রতিবন্ধী ১০০ ও অন্যান্যভাবে ১৩৯ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশুর সংখ্যা ছিল ৬২৬ জন। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৭৪ দশমিক ৪৩ ভাগ।
বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম দেশ হিসেবে যে দেশে নারীরা থাকার কথা চরম নিরাপদে সকল পুরুষের স্ব স্ব সংযত সভ্যতার কারণে। তা তো হয়-ইনি; বরং মসজিদ-মন্দির-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি গীর্জাতেও ঘটেছে ধর্ষণ-খুনের ঘটনা। তারই সূত্রতায় আমাদের দেশে ২০২১ সালে ১১৬ কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২০ সালের তথ্য মোতাবেক, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল ১০৪ জন। পরিসংখ্যান বলছে, গণ বছরের তুলনায় এ বছর যৌন হয়রানি বৃদ্ধির হার প্রায় ১২ শতাংশ। নির্যাতনগুলোর অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছে রাস্তায়, নিজের বাসায়, নিকটতম আত্মীয়-পরিজন ও গৃহকর্তার দ্বারা। যৌন নির্যাতনে অপেক্ষাকৃত নুুন ধরন পর্নোগ্রাফি। ২০২১ সালে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৫২ কন্যাশিশু। ২০২১ সালে অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হয়েছে ১০ কন্যাশিশু। পারিবারিক বিবাদ, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, সম্পত্তি সংক্রান্ত আক্রোশের কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ২০৬ কন্যাশিশু। এর মধ্যে অপহরণের শিকার ১৯৭ জন। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ নভেম্বর পর্যন্ত মোট বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৮৬৮ কন্যাশিশু। গড়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ২১ জন কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০১৯ সালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিল ২ হাজার ৫০৩ কন্যাশিশু। ২০২১ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৭ কন্যাশিশু। এরমধ্যে যৌতুক দিতে না পারায় ৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ২০২১ সালে গৃহশ্রমিক নির্যাতনে ৩৫টি ঘটনার খবর জানা গেছে। এরমধ্যে ১৮ জনকে শারীরিক নির্যাতন, ৫ জনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও ১২ জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২৪২ কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। ২৭২ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৩৫ কন্যাশিশুকে বিভিন্ন স্থানে ফেলে রেখে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
ধর্ষণ-নির্যাতন-খুন বন্ধে করণীয় প্রসঙ্গে আমি গত ২৩ বছর ধরে বলে আসছি- ‘মসজিদ-মন্দির-গীর্জা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি ধর্মীয়ভাবে শ্রদ্ধা-সুব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা-উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। একই সাথে এক একজন পুরুষকে এক একজন নীতিবান মানুষ হওয়ার শিক্ষা যেমন দেয়া হবে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রর পক্ষ থেকে; তেমনি নারীকে সভ্যতার সাথে জীবন গড়ার দীক্ষা দিতে হবে।’ পাশাপাশি শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সব ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা, মামলা ও ধর্ষণ সংশ্লিষ্ট সব প্রকার অভিযোগের ক্ষেত্রে, ঘটনার শিকার কন্যাশিশু ও নারীর পরিবর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে ও আইনের আওতায় আনতে হবে। নারী ও শিশুকে অপদস্থ না করে অভিযুক্তের কাছে প্রমাণ চাইতে হবে যে, সে অপরাধী না। এ সম্পর্কিত প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করতে হবে। সব ধরনের পর্নোগ্রাফির সাইট বন্ধসহ পর্নোগ্রাফির বির”দ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এছাড়া, শিশু সুরক্ষায় শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠন করতে হবে। করোনাকালে আর্থিক সংকটের কারণে অভিভাবকরা নাবালক কন্যাদের বিয়ে দিচ্ছে, ফলে বাল্যবিয়ে বহুগুণে বেড়েছে, সোশাল সেফটিনেটের বাজেট বৃদ্ধি করে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কন্যাশিশু ও তাদের অভিভাবকদের এর আওতায় আনতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। নির্যাতন বন্ধে বিদ্যমান আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ক্রমবর্ধমান কন্যাশিশু ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষ, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া পরিবার সবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
জীবন চলার পথে চলতে চলতে কেন যেন মনে হচ্ছে- পরিবার ও আপনজনেরাও আর নারীর জন্য নিরাপদ নয়। অতি আপনজন বাবা-চাচা, স্বামী, ভাই হয়ে উঠছে নিপীড়ক। আপনজনদের দ্বারাও নারীর জীবন এখন হুমকির মুখে পড়ছে। মানসিক অবক্ষয়, নৈতিকতার অভাব, মাদকাসক্ত, মানসিক ভারসাম্যহীনেতার কারণে এখন অনেক পরিবারেই বর্ণনাতীত কিছু অমানবিক ও পাশবিক ঘটনা ঘটছে। এমতবস্থায় আমাদেরকে হতে হবে বিশ^াসী আল্লাহর উপর, হতে হবে নীতিবান, আদর্শবান। প্রমাণ দিতে হবে বিশ^ব্যাপী একমাত্র বাংলাদেশ-ই পুরুষ দ্বারা নারী সবচেয়ে নিরাপদ। প্রমাণ দেয়ার সময় এসেছে এ দেশ পুরুষতান্ত্রিক নয়; এ দেশ মানবতান্ত্রিক। সকল মানুষ সত্যিকার্থেই তাঁর ¯্রষ্টাকে বিশ^াস করে, আর তাই নারীরা নিরাপদে ফেরে ঘরে। পুরুষরা রাখে তাদেরকে সংযত সবসময়। কোথাও তাদের কাছে, কখনো নারীকে তেতুল মনে হয় না। মনে হয় ‘আমার মা, আমার বোন, আমাদের শ্রদ্ধাজন...’
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ।