সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি। এমন তথ্য জানার পরপরই মনে হয় আমাকে লিখতেই হবে চলমান নিদারুন সংকটগুলো নিয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিক আর প্রশাসনিক ক্ষমতার দাপটে আমজনতা এখন নির্মম বাস্তবতার দিকে এগিয়ে চলছে। ছাত্র-যুব-জনতার অধিকার হারাতে বসেছে। কোন নারী কেন টিপ পড়লো, কোন নারী কেন হিজাব পড়লো? এসব নিয়ে চলছে ক্ষমতার চর্চা! চলছে ছলাকলার রাজনীতি। এরইমধ্যে দেশের ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও নেই স্বস্তি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ। যানজট, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, গ্যাস সংকট, দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি, সড়কে মৃত্যু, খুন, ডায়রিয়া-এমন নানা ভয়াবহ সংকট নিয়ে চলছে নগরবাসীর জীবন। কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। দুর্বিষহ এমন জীবনে এই মুহূর্তে কোথাও আশার আলো দেখছেন না তারা। সবার একটাই প্রশ্ন-যাবে কোথায় মানুষ! কি করবে, কিভাবে চলবে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন নির্মাণ হচ্ছে কেবল। লোভি-বদমায়েশদের কারণে নির্মমভাবে বাজারে দ্রব্যমূল্য যেমন বাড়ছে, তেমন বাড়ছে অধিকার হরণের প্রতিযোগিতা। আমার দেখা ১৯৯৫ থেকে এই সময় পর্যন্ত একজন নগণ্য লেখক হিসেবে বলতে পারি- এতদিন ঘরের বাইরে নানা ভোগান্তি পেরিয়ে বাসায় ফিরে অন্তত ঠিকমতো রান্নাটা করতে পারত দেশের মানুষ। কিন্তু রমজান শুরুর পর থেকে ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। রোজা রেখে বাসায় পছন্দের ইফতারিও তৈরি করতে পারছেন না অনেকে। কোথাও নির্দিষ্ট সময়ে গ্যাস এলেও অনেক এলাকায় চুলাই জ¦লছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাইরে থেকে খাবার কেনা অনেকটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে। বাসায় যখন গ্যাস নেই ঠিক সেই সময়ে আসে আরেক দুঃসংবাদ। ফের বাড়ানো হয়েছে এলপিজির দাম। এ নিয়ে চার মাসে অন্তত এর দাম বাড়ল চারবার।
বিশে^র অন্যান্য দেশে রমজান উপলক্ষে যখন দ্রব্যমূল্য কমাচ্ছে, তখন বৃহত্তর দ্বিতীয় মুসলিম দেশের তকমা লাগানো বাংলাদেশের রোজার আগেই দ্রব্যমূল্য দফায় দফায় বাড়তে থাকে। তেলসহ কিছু পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অনেকে ছুটছেন টিসিবির ট্রাকের দিকে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে চারদিকে যখন হইচই এ সময় শুরু হয় রমজান। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নজর পড়ে রমজান কেন্দ্রিক পণ্যের দিকে। ইফতারি তৈরির প্রতিটি পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। কয়েকদিনের ব্যবধানে বেগুনের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে একশ টাকায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে ইফতারি বাজারেও। পিয়াজু, বেগুনি, ছোলা থেকে শুরু করে হালিম সব আইটেমের দাম চড়া। ইফতারিতে ফলমূল সবারই প্রিয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তা হয়ে উঠেছে দুষ্প্রাপ্য। রমজানকে কেন্দ্র করে সব ফলের দাম বেড়েছে। টেনে চালানো সংসারে ইফতার পণ্যের অতিরিক্ত খরচে দিশেহারা মানুষ। জীবন সংসার চালাতে দিনের শুরুতেই মানুষকে পড়তে হচ্ছে সীমাহীন যন্ত্রণায়। দেশের যানজট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে ঘর থেকে বের হলেই তা শুরু। যানজটে অলিগলি, প্রধান সড়ক সব জায়গায় স্থবিরতা। তীব্র গরমে এমন অসহনীয় যানজটে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। একপ্রকার যুদ্ধক্ষেত্র জয় করে তাদের যেতে হয় কর্মক্ষেত্রে। এ থেকে সহজে মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না দেশবাসী।
সারাদেশে সড়কপথ দুর্ঘটনাও এখন নির্মম আতঙ্কের রূপ নিয়ে এসেছে ছাত্র-যুব-জনতার সামনে। একটি বিষয় এখন নিদারুন কষ্টের হয়ে দাড়িয়েছে। আর তা হলো- ঘর থেকে বেরোনোর পর আবার সুস্থ শরীরে বাসায় ফিরতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নই সবার মধ্যে। স্কুলগামী ছেলেমেয়ের হাত থেকে ঘাতকরা কখনো মা, কখনো বাবাকে কেড়ে নিচ্ছে। কেউ নিরাপদ নয়। রাজধানীতে মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে ঘাতক পরিবহণ। কোথাও নিরাপদ নয় দেশবাসী। সড়কপথ দুর্ঘটনার পাশাপাশি সড়কে ওতপেতে থাকেন ভয়ানক ছিনতাইচক্র। জীবন সংসার চালাতে ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে অনেকেই পড়ছেন ছিনতাইয়ের কবলে। সবকিছু কেড়ে নিচ্ছেন তারা। অনেককে আবার দিতে হচ্ছে জীবনও। শুধু ছিনতাইকারী নয়, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। গত ছয় মাসে রাজধানীতে ২০-এর অধিক মানুষ খুন হয়েছেন।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজী, সংসন্ত্রাসসহ অসংখ্য সংটকে হারিয়ে যাচ্ছে আমজনতার সকল স্বপ্ন-সম্ভাবনা। অসংখ্য চারপাশে জগদ্দল পাথ হয়ে এসেছে বিধায়-ই সংকট মানুষের পিছু ছাড়ছে না। করোনার মহামারি নিয়ন্ত্রণে এলেও নতুন করে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া। প্রতিদিন হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে ভয়ের সৃষ্টি করেছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে চিন্তিত প্রতিটি পরিবার। ঘরে-বাইরে এমন নানা সংকট আর অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে দেশবাসীকে। দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে সবাই প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপেই এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারেন তারা। কারণ হিসেবে বলতে পারি- মন্ত্রী-এমপি-জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে যেই মুখগুলো দেখা যায়, অধিকাংশই শো-পিস। এরা তাদের কোন দক্ষতা- যোগ্যতা- মেধার পরিচয় দিতে পারেনি গত ১৩ বছরে। সকল কাজই করতে হয় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সারা জাগানো দক্ষতায় এগিয়ে চলা বাংলাদেশের রাজধানীটি এখন বিশে^র ১৪০ টির মধ্যে ১৩৭ তম বাস অযোগ্য রাজধানী। এই দেশেরই একাংশের মেয়র হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরসূরী শেখ ফজলে নূর তাপস, আরেক অংশের মেয়র ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলাম। দুজন মেয়রের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ; আর আওয়ামী লীগই ক্ষমতাসীন সরকারের নেতত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দল। এই দল যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবার বলেছে- আমরা ১০ টাকা কেজী চাল খাওয়াবো, উন্নয়নের রোল মডেল করবো বাংলাদেশকে। কিন্তু তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে কেবল অপরিকল্পিত পদপেক্ষেপের কারণে। একই কারণে নির্মমতার রাজধানীতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। উত্তরণে নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে কালোকে কালো আর শাদাকে শাদা বলার রাজনৈতিক সাহস থেকে পথ চলছি। সেই চলার ধারাবাহিকতায় বলতে চাই- কেবলমাত্র অপরিকল্পনার জন্য দেশে সীমানা নির্ধারণের অজুহাতে আটকে আছে ঢাকার খালগুলোর উদ্ধার প্রক্রিয়া। যেগুলো নিয়ন্ত্রণে আছে তার অনেকগুলোই প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ নেই। এতে দ্রুত পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে রাজধানী ঢাকা। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের কথাই বলা হচ্ছে। এখন যুগ পার হতে চলেছে একই দোহাই দিয়ে। বাস্তবে কাজ না হলেও বন্ধ নেই এ খাতের ব্যয়। দেশের ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে এক যুগে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এরপরও জলাবদ্ধতা কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে কয়েকগুণ।
এই বাস্তবতায় আমাদের দেশকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রয়োজন ছিলো সুপরিকল্পনা। যা নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন সে সরকারের রাষ্ট্রিয় প্রশাসন। নীতিগত-আদর্শগত জায়গা থেকে কখনো সত্য বলা থেকে পিছপা হইনি; আর তারই ধারাবাহিকতায় বলতে হচ্ছে যে, টেকসই পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ না নেওয়ায় খালগুলোর দখল-ভরাট বেড়েছে। চারপাশের নদ-নদীর সঙ্গে খাল ও নর্দমার পানি নিষ্কাশন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পাম্পিং নির্ভর হয়ে পড়েছে ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে ঢাকার প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্র। বাড়ির ভেতরও পানি ঢুকে পড়ছে। সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে দেশবাসী।
স্বাধীনতার পর ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে খাল, নর্দমা, ড্রেন সংস্কার, উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের নামে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রকল্পের নামে এবং রুটিন ব্যয় হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে। এদের কাছে ব্যয়ের সঠিক হিসাবও নেই। এতকিছুর পরও ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান মেলেনি। ঢাকায় কার্পেটিংয়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জলাশয়ের পরিমাণ কমে গেছে। এতে করে প্রতিবছর নতুন নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের অসংখ্য বেদনা-দুঃখ-কষ্টের মধ্যে এগিয়ে চলার সময়ের হাজারো সমস্যার জালে আবদ্ধ হওয়া বাংলাদেশে শহর উন্নয়নসহ ১২ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ১৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৭ হাজার ৯৯০ কোটি ১৪ লাখ টাকা, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৩ হাজার ৪৩২ কোটি এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে ৫৯৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। দেশের শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। গণভবন থেকে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। কিন্তু দুর্নীতির হাত ধরে এগিয়ে চলা বাংলাদেশে আরবান ডেভেলপমেন্ট এ- সিটি গভর্ন্যান্স প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৯৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এরমধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ হাজার ১৮২ কোটি ২৫ লাখ টাকা, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণ থেকে ২ হাজার ২১৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। চলতি বছর থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। কিন্তু কি বাস্তবায়ন করবে? এই বাস্তবায়ন নীতিবানরা করবে নাকি ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজরা করবে? যদি দুর্নীবিাজদের হাতেই যায় আমজনতার কোটি কোটি টাকার কাজ! তাহলে আর তা টেকসই হবে না যেমন, তেমন কষ্টের পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শিল্পকলা একাডেমি ও আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মিঠামইন, কিশোরগঞ্জ প্রকল্পের ব্যয় ধরা ৬৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকার কাজ যদি দুর্নীতির রাঘব বোয়ালরাই করে তাহলে ঘরে ঘরে দুঃখি মানুষের দুঃখ কিছুটা বাড়বে। বাংলাদেশ ওশানো গ্রাফিক রিসার্চ ইস্টিটিটিউট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের ব্যয় ধরা ৪৪৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকারও অধিকাংশই যাবে দুর্নীতিবাজদের পেটে, পাচার হয়ে যেতে পারে সরকারি শিশু পরিবার এবং ছোট মনি নিবাস হোস্টেল নির্মাণ, পুননির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা ৮৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকার একটি বড় অংশ তথাকথিত ঠিকাদারদের হাত ধরে।
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি।