মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর কাছে গত ১০ মাস পূর্বে লিখিতভাবে আবেদন করেছিলেন এক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। মন্ত্রী বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ প্রদান করার দশ মাসেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। ফলে চরম বিপাকে পরেছেন ওই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও স্থানীয় একাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমানিত হওয়ার পরেও ওই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রোববার সকালে হয়রানীর স্বীকার জেলার গৌরনদী উপজেলার সরিকল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের দিনমজুর ছেলে নাছির হাওলাদার বলেন, আমার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২০০৪ সালে উপজেলা ভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই সভায় চূড়ান্তভাবে তালিকাভূক্ত হয়। তার বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নং-৩৪৯৩, লাল বই মুক্তিবার্তা নং-০৬০১১০০৬৮২, সাময়িক সনদ নং ম-১২৬১৯২, এমআইএস নং-০১০৬০০৩৯৪৮। ভাতা বই নং- ৫৫১। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সোনালী ব্যাংক, গৌরনদী শাখার ০৩১২১০০১৪০৫৯ সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরের মাধ্যমে সরকারের দেয়া সম্মানিভাতা ভাতা উত্তোলন করে আসছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালের ৮ আগস্ট তিনি (মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম) মৃত্যুবরন করেন। মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। জীবিতকালীন সময়ে কর্মের সুবাধে ঢাকায় বসবাসের সময় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও রফিকুল ইসলাম বাবলার হাত থেকে একাধিক সম্মাননা গ্রহণ করেছেন।
নাসির হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, বাবার মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা আমার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর-০৩১২৯০১০১৯৬৬৬ এর মাধ্যমে উত্তোলন করে আসছিলাম। এরইমধ্যে এমআইএস ফরমের ভুলক্রটি সংশোধনের জন্য অনলাইন থেকে ফরম উত্তোলন করতে গিয়ে আমার পিতার নামধারী অপরিচিত এক লোকের ছবি দেখতে পাই।
পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি অপরিচিত ওই ব্যক্তি মুলাদী উপজেলার গাছুয়া এলাকার বাসিন্দা। সে নিজাম উদ্দিন ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক ছিলো। আমার মুক্তিযোদ্ধা পিতা নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর স্থানীয় এক প্রভাবশালী মুক্তিযোদ্ধার নেপথ্য মদদে এবং উপজেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের অফিস সহকারী নুরুজ্জামানের সহযোগিতায় এমআইএসে আমার পিতা নুরুল ইসলামের ছবির পরিবর্তে মুলাদী উপজেলার বাসিন্দা অন্য এক নুরুল ইসলামের ছবি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
পুরো ঘটনাটি উল্লেখ করে গত ১০ মাস পূর্বে লিখিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর কাছে আবেদন করা হয়। মন্ত্রী বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ প্রদান করেন। মন্ত্রীর নির্দেশে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে তদন্তের শুনানীতে দুইবার মুলাদীর নুরুল ইসলাম ভুয়া হিসেবে প্রমানিত হয়। এমনকি সে আর কোনদিন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করবে না বলেও ইউএনও’র কাছে লিখিত মুচলেকা প্রদান করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অদ্যবর্ধি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি।
মুলাদীর গাছুয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল জলিল জানান, নুরুল ইসলাম নামের ওই ব্যক্তি আমার কাছে একবার এসেছিলেন। তিনি মুলাদীতে যুদ্ধ করেননি। এই নামে কোন মুক্তিযোদ্ধা গাছুয়ায় নেই। অন্য কোথাও যুদ্ধ করেছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই।
সরিকল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুল হক আকনের ছেলে নান্না আকন জানান, মুলাদীর নুরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের এলাকায় এসেছেন। আমার মরহুম পিতাকে তিনি বাবা বলে ডাকতেন। তবে সরিকল এলাকায় যুদ্ধ করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই।
ইউএনও’র কার্যালয়ে শুনানী বৈঠকে উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ হক বীর বিক্রম বলেন, নাসিরের বাবা সরিকলের নুরুল ইসলাম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। মুলাদীর নুরুল ইসলাম কখনো গৌরনদীতে মুক্তিযুদ্ধ করেননি বলে ইউএনও এবং শুনানীতে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে লিখিত মুচলেকা দিয়েছে। এর কিছুদিন পর আবার ওই ব্যক্তি কতিপয় কু-চক্রী মহলের সহযোগিতায় ভুল করে মুচলেকা দেয়া হয়েছে জানিয়ে পূনরায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করেন। আর তার দ্বিতীয়বারের এ দাবীর বিষয়টি প্রশাসন কিভাবে মেনে নিচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি (এমএ হক) সরিকলের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের পরিবারকে হয়রানি বন্ধ করার পাশাপাশি এমআইএসের ছবি ও তথ্য পরিবর্তন করার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির দাবী করেন।
পুরো বিষয়টি নিয়ে মুলাদী উপজেলার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ব্যবহৃত (০১৭১২-৩০৮৯১৮) মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তাকে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর ফোনের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে তা বন্ধ করে দেন। ফলে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গৌরনদী উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অফিস সহকারী নুরুজ্জামান তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ ঘটনার সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। পুরো ঘটনার তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে। তবে অতিশীঘ্রই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস।