অনেকেই না বুঝে অনেক কথা বলছেন। বিশেষ করে গত কয়েকদিনে যা প্রচার হচ্ছে, তাতে তারা বলছেন-দ্বিতীয় শক্তিশালী নদী পদ্মা। কিন্তু এটা প্রথম শক্তিশালী নদী। এর চেয়ে আমাজনে বেশি প্রবাহ হলেও নদীর প্রশস্ততার ভিত্তিতে শক্তিটা পদ্মার সবচেয়ে বেশি।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত উল্লিখিত মন্তব্য করে আরও বলেন, রাজশাহী শহরের দিকে চার থেকে ছয় কিলোমিটার পদ্মা নদীর প্রশস্ততা। আর প্রাকৃতিকভাবে নদীটা যখন মাওয়াতে এল তখন তার প্রশস্ততা দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার। ফলশ্রুতিতে এখানে নদী প্রচন্ড গভীর হয়ে গেছে। শীতের সময় এর গভীরতা ৮০ ফিট ও বর্ষার সময় ডাবল হয়ে যায়। বর্ষার সময় পানি যখন উপরে উঠে যায়, তখন তলদেশও তার থেকে অনেক বেশী নীচে নেমে যায়। এই ন্যাচারাল স্ক্যাওয়ারে মাওয়ার কাছে পদ্মার গভীরতা ডাবল হয়ে যায়। এ গভীরতায় সেতু নির্মাণ পৃথিবীতে আর কোথাও করা হয়নি।
পদ্মা সেতুর নির্মান প্রক্রিয়ার সাথে শুরু থেকে যুক্ত থাকায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে পদ্মা সেতুর নির্মান পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, অদ্ভুদ একটা কারণ দেখিয়ে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করে বিশ্বব্যাংক বুঝেছে তাদের সিদ্ধান্তে ভুল ছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মানের জন্য যে শক্ত পজিশন নিয়েছিলেন, সেটি আজ শুধু সেতু বিভাগ নয়; দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকা-ে বিরাট প্রভাব রেখেছে।
ড. আইনুন নিশাত বলেন, আমি মনে করি পুরোপুরি রাজনৈতিক কারণে বিশ্ব ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অদ্ভুদ কারণ দাঁড় করিয়েছিলেন। বাংলাদেশে যারা অর্থ লব্দি করে, তাদের আমি দাতা বলিনা। কারণ তারাতো ফ্রি অর্থ দেয়না। ইন্টারেস্টসহ আদায় করে নেয়। তারা প্যারিসে বসে ঠিক করে বাংলাদেশে কি হবে, কোথায় কে কি করবে। এটা বন্ধ হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্স শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে ড. আইনুন নিশাত বলেন, যমুনা সেতু নির্মান করতে না পারলে পদ্মা সেতুর কথা ভাবতে পারতাম না। যমুনা সেতুর অভিজ্ঞতা নিয়েই পদ্মা সেতুর কাজ হয়েছে। যমুনা নদী ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার ছিলো, সেজন্য সাড়ে চার কিলোমিটার সেতু করা হয়েছে। ৮৭-৮৮ এর বন্যায় এটা কিছুটা প্রশস্ত হলেও সেতু নির্মানের আগে নদী মূল জায়গাতে চলে আসে। যমুনা সেতুর সময় লেটেস্টে প্রযুক্তি গ্রহন করা হয়েছিলো। পদ্মা সেতুর সময় প্রযুক্তি অনেক অ্যাডভান্সট হয়েছে। আর সেগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে। তবে পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ কোনদিন স্বপ্নেও বিশ্বাস করতাম না। কারণ এটা অত্যন্ত শক্তিশালী নদী। এখন ফেলোসিটি সাড়ে চার মিটার প্রতি সেকেন্ডে। অর্থাৎ তীব্র ¯্রােত।
পদ্মা সেতু ফ্লাট হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নেভিগেশন চ্যানেল পরিবর্তন হতে পারে তাই পুরো সেতুজুড়ে ক্লিয়ারেন্স রাখা হয়েছে। সারাবছর ধরে যাতে নৌযান চলাচল করতে পারে তাই বর্ষার সময় পানির উচ্চতা ধরে সেতুর উচ্চতা ঠিক রাখা হয়েছে।
সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে পদ্মা সেতু ॥ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে “পদ্মা সেতু এবং এর আর্থ-সামাজিক প্রভাব” শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। ১৯ জুন দিনভর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনানন্দ দাশ কনফারেন্স হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ কর্তৃক আয়োজিত কনফারেন্সের প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। দক্ষিণাঞ্চল হবে শিল্পসমৃদ্ধ নগরী। যা দেশের অর্থনীতিতে বিস্তর প্রভাব ফেলবে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়াবে বরিশালসহ গোটা দক্ষিলাঞ্চল।
ইলিশ বিচরণের দিকে খেয়াল রেখে কাজ করা হয়েছে ॥ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ছিলো পরিবেশের বিষয়ে যাতে কোন কনফারমাইজ করা না হয়। সেইসাথে সার্বিক গুনগতমানের ক্ষেত্রেও কোন ধরণের ছাড় দেয়া যাবেনা। আমরা যারা পদ্মা সেতুর সাথে জড়িত ছিলাম তারা চেষ্টা করেছি সেটা রক্ষা করতে। যার ধারবাহিকতায় ইলিশ মাছের সময় পদ্মা সেতুর উচ্চ কম্পন ও শব্দরোধে কোন কাজ করা হয়নি। আমাদের বলা হয়েছে-যেখানে নদীর গভীরতা ৩০ ফুটের বেশি সেখানে মৎস্য মন্ত্রণালয় যদি বলে ইলিশ মাছ যাচ্ছে, তাহলে কাজ বন্ধ। আমরা তাই করেছি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর তলা দিয়ে ইলিশ মাছ যাতায়াত করে। আবার দুইশ’ ডেসিমালের ওপরে শব্দ হলে ইলিশ সেদিকে আগায় না। অর্থাৎ এই শব্দে ইলিশ মাছ উল্টো দিকে চলে যায়। সেজন্য হ্যামরের পেটানোর সময় যাতে উচ্চ শব্দ না হয়, সেজন্য পাইলকে মাফলার দিয়ে মোড়ানো হয়েছিলো।