২৪শে ফেব্রুয়ারী ২০২২ বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়া তার সাবেক অঙ্গরাষ্ট্র এবং বর্তমান প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট ইউক্রেনে বিশেষ অভিযানের নামে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ত্বরিৎ রাজধানী কিয়েভের উপকন্ঠে পৌঁছে যায়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অপসারণ করার আহবান জানান এবং তাদেরকে নিরস্ত্রীকরণের নির্দেশ দেন। মূলতঃ রাশিয়া ইউক্রেনকে দখল করার পরিবর্তে সেখানে রুশ বান্ধব প্রেসিডেন্ট ও সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই চেয়েছিল। কেননা ইহুদী সন্তান জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা ঘনিষ্ট এবং রাশিয়ার বিরোধিতা সত্বেও ন্যাটোতে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কয়েক বছর আগে রুশ পন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ গণ বিক্ষোভের তোড়ে দেশ ছেড়ে পালান। ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে রুশপন্থী প্রার্থী পেট্রো পোরেশেস্কোকে পরাজিত করে তখনকার জনপ্রিয় টিভি সিরিজ “দি সারভেন্ট অব দি পিপল”-এর জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতা ভলোদিমির জেলেনস্কি জয়লাভ করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হন। মূলত: তখন থেকেই শুরু হয় পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক কূটনীতির নাটক। আর ইউক্রেন হল তার রণমঞ্চ। বর্তমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের গুরু বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র যার সংগে পার্শ্ব চরিত্রে আছে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রাশিয়াকে খলনায়ক বা ভিলেন হিসেবে চিত্রায়িত করার সব চেষ্টাই করা হচ্ছে। এই মঞ্চায়নের মহরৎ জেলেনস্কির আবির্ভাবের পরপরই শুরু হয়েছে। রাশিয়া যে আক্রমণ করতে বাধ্য হবে এই হিসাব-নিকাশ তখন থেকেই কষা হয়েছিল। অস্ত্র-শস্ত্রের যোগান, প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষক সরবরাহ, দুর্গ তৈরী, যোদ্ধা সরবরাহ সবই চলছিল পর্দার অন্তরালে। যুদ্ধ শুরুর পর মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র-সস্ত্র সরবরাহ ¯্রােতের মত আসছে ইউক্রেনে। দুই পক্ষ থেকেই যুদ্ধের কৌশল ও থিয়েটার পরিবর্তন হচ্ছে। কূট ও রণকেলী জমে উঠেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেন হচ্ছে বলির পাঁঠা। ধ্বংশ যা হচ্ছে তা হচ্ছে ইউক্রেনের। মৃত্যু হচ্ছে ইউক্রেনের নিরীহ মানুষের, ঘর-বাড়ী-স্থাপনা এবং অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংশ হচ্ছে, দেশান্তরী হচ্ছে ইউক্রেনবাসী, দেশের অর্ধেক চলে গেছে রাশিয়ার দখলে। মূলতঃ এ যুদ্ধের ফলাফলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ ইউক্রেন। এখনো বলা হচ্ছে রাশিয়ার মত পরাশক্তির কাছে ইউক্রেন পরাজিত হবে না, হবে রাশিয়া। এর চেয়ে গুল মারা আর কি হতে পারে ? এটা একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা যদিও ধ্বংশাতœক। এই খেলার উদ্যোক্তা আমিরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ হচ্ছে মূলতঃ রাশিয়ার বিরূদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের। ইউক্রেন একটা উপলক্ষ্য এবং এই খেলার মাঠ। রাশিয়াকে বাধ্য করা হয়েছে ইউক্রেন আক্রমণ করতে। রাশিয়াও এই দাবার চাল বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু উপায় ছিলনা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এমনিতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া তার কয়েকটি প্রজাতন্ত্র হারিয়েছে যারা এখন ন্যাটোভুক্ত স্বাধীন দেশ। ঐ সব দেশে ন্যাটোর ঘাঁটি ও অস্ত্র মজুদ করা হয়েছে। ইউক্রেনকে ন্যাটোর অধীনে না গিয়ে নিরপেক্ষ থাকতে বলেছিল রাশিয়া, পরিনতি সম্পর্কে হুশিয়ার করা হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা কূট চালে ইউক্রেন শিকারে পরিনত হল। ইউক্রেনকে রক্ষা করার অংগীকার করেছিল পশ্চিমারা। তা করে নি। যুদ্ধের দুইমাস পার হওয়ার পর ইউক্রেনের ধ্বংশস্তুপে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে “পশ্চিমারা কথা রাখেনি”। বরং তাদের মধ্যে ইউক্রেনের ব্যপারে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। তারপরও তিনি ব্যপকভাবে সাহায্যের আশা ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া আর কিই বা করার ছিল, তিনি বাঘের পিঠে চড়ে বসেছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র-শস্ত্র, সর্বশেষ উন্নত সংস্করণের মিসাইল, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র সবই দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অর্থ সাহায্য দিচ্ছে উদারভাবে যা ইতোপূর্বে আর কোন দেশকে তারা দেয়নি। গোয়েন্দা তথ্য দিয়েও সাহায্য করছে তারা। তাই এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিরূদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর একটি প্রক্সি যুদ্ধ।
এই যুদ্ধের পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এই পরিস্থিতি রাশিয়া সৃষ্ট নয়। এই নাটকের প্রযোজক-পরিচালক যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের মঞ্চ ইউক্রেন হলেও পর্দার অন্তরালে কল কাঠী নাড়ছে বর্তমান বিশ্বের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র, সহযোগী রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো যারা যুক্তরাষ্ট্রের কথায় উঠ্ বস্ করছে। এমনিতেই রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলে আসছিল সেই সোভিয়েত আমল থেকেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাংগনেও সমাজতন্ত্র বা কম্যুনিজমের বিরূদ্ধে গণতন্ত্রের চাল ব্যবহার করে পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অনেক অংগরাষ্ট্র এখন স্বাধীন এবং ন্যাটো সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র এক হাত নিয়েছে রাশিয়ার উপর। এখন রাশিয়াকে একঘরে ও দূর্বল করাই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের খায়েশ। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তারা। ইউক্রেনকে উস্কে দিয়ে এই সুযোগটা লুফে নিল। আর দেরী না করে তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর অবরেধে রাশিয়াকে কাবু করার প্রয়াস শুরু হল। একই সংগে ব্যপকভাবে সর্বাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে ইউক্রেনকে দিয়ে প্রতিরোধ করে যুদ্ধকে প্রলম্বিত করছে যাতে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে ও সামরিকভাবে দূর্বল করা যায়। কিন্তু কোনটাই তেমন সফল হয়নি। দুর্বল ও ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন, ইউক্রেনের মানুষ ও সম্পদ। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু আসে যায় না। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করাইতো তাদের উদ্দেশ্য। তারা নিজেরাও বিলিয়ন বিলিয়ন এমনকি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ব্যয় করছে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্যে। ওদিকে অবরোধে রাশিয়ার যা ক্ষতি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ইউরোপীয় অনেক দেশের। কারন, রাশিয়ার তৈল ও গ্যাসের উপর তারা নির্ভরশীল। মন্দা দেখা দিচ্ছে ইউরোপে। তাই তারা গোপনে অর্থাৎ চুরি করে রাশিয়ার জ্বালানী ও গ্যাস কিনছে। জার্মানী, ফ্রান্স এবং ইটালী আগের চেয়ে অধিক পরিমানে তৈল ও গ্যাস কিনছে রাশিয়া থেকে। আন্তজার্তিক বানিজ্যে রাশিয়া বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে রুবেলের অবস্থানও টিকিয়ে রাখছে, বানিজ্যও করে যাচ্ছে। তাই ইউরোপীয়দের মধ্যে মতবিভেদ ও ভাংগন সৃষ্টি হচ্ছে। তারা অবাধ অস্ত্র যোগানে দ্বিমত পোষণ করছে এবং অবরোধ শিথিল করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়ার সুবাদে সব ধরণের প্রপাগান্ডায় রাশিয়ার বিরূদ্ধে ছাপাই গাওয়া হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বড় করে দেখা হচ্ছে। রাশিয়াকে একঘরে করার সব চেষ্টাই করা হচ্ছে এবং পুতিনকে ভিলেন, নিষ্ঠুর, এক নায়ক, যুদ্ধপরাধী সব খেতাবই দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে পৃথিবীর দেশে দেশে (অন্তত: ৫০টি দেশে) সরকার পরিবর্তন করে নিজের তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮০০টির বেশী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং সেনা সমাবেশ করেছে, ইরাক আফগানিস্তানের মত দেশে ধ্বংশযজ্ঞ চালিয়েছে, সরকার প্রধানদের হত্যা করেছে, ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ এমন অবস্থায় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসিকিকে বোমায় ধূলা করে দিয়েছে তার জন্য তার বিরূদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি, এমন কি মিডিয়াতেও প্রচারিত হয়নি। কারণ তারা যা করেছে তার লেবেল হল তথাকথিত গণতন্ত্র।
রাশিয়া ও পুতিনের অতীত ইতিহাসেও অনেক কলংক আছে। তারা বিশ্বে মোড়ালিপনা করার জন্য অন্য দেশে কম মাথা ঘামালেও নিজ দেশ ও ধর্মের স্বার্থে অনেক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে এবং কেজিবির সাবেক কর্মকর্তা পুতিন নিজে তা করেছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে মৌসুল ও গ্রোজনীকে নির্মমভাবে ধ্বংশ করেছে, কারণ তারা স্বাধীনতা চেয়েছিল। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি, কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস, সোভিয়েত আমলে কমিউনিজমের দমন নীপিড়ন নীতি এবং ককেশীয় অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যসমূহে নিষ্ঠুরতা উল্লেখযোগ্য। রাশিয়া ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্তৃক দোনেস্ক (Donetsk) এবং লুহানস্ককে (Luhanosk) স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পুতিন তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। অথচ ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে কয়েকটি অংগরাজ্য স্বাধীন হয়ে যায়। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত চেচনিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি না দিয়ে পুরো চেচনিয়াকে গুঁড়িয়ে দেয়। চেচনিয়া এখন রাশিয়ার একটি অঙ্গরাজ্য। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রও পৃথিবীতে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যাটো (NATO), ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়ার মত দেশে সামরিক অভিযানে নিষ্ঠুরতার সাথে ধ্বংশ যজ্ঞ চালায়, রাষ্ট্র প্রধানদের নির্মমতার সাথে হত্যা করে। পৃথিবীর বহু দেশে সরকার পরিবর্তন করে যার সর্বশেষ ছিল প্রেসিডেন্ট ইমরান খানকে হটিয়ে পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। তারা সব ঘটনাই ঘটায় গণতন্ত্রের আবরণে এবং মানবাধিকার রক্ষার দোহাই দিয়ে। তাদের কূটচালে জাতিসংঘ এবং এর অংগ সংস্থাগুলো তাবেদার হিসেবে কাজ করে। কথায় বলে জোর যার মূলুক তার। পৃথিবীর মালিক যেন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা। কে বলবে আফগানিস্তানে, ইরাক, সোমালিয়ায়, লিবিয়ায় মানবাধিকার লংঘিত হয়নি, সর্বভৌমত্ব লংঘিত হয়নি, পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে আল কায়দা নেতা বিন লাদেনকে গোপন অভিযানে তুলে নিয়ে হত্যা করে সার্বভৌমত্ব ও মানবাধিকার লংঘন করেনি ?
ইউক্রেন যুদ্ধের বহুমাত্রিকতা রয়েছে। এই যুদ্ধের মূল উপলক্ষ্য ইউক্রেন নয়, ইউক্রেন একটি রণমঞ্চ যেখানে অভিনয় করছে প্রধান ভূমিকার যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। তাদের কূটনৈতিক, রণনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক মিশন বা লক্ষ্যের বলি ইউক্রেন। যুদ্ধে কার কি লাভ লোকসান হবে সেটির হিসাব নিকাশতো আছেই। তবে ইউক্রেনের কোন লাভ হবে না এটা বলা যায়। ইতোমধ্যে তিন চার মাসের যুদ্ধে ধ্বংশস্তুপে পরিণত হয়েছে ইউক্রেন। আরো নিশ্চিত করে বলা যায় যে ইউক্রেন তার ভূমির বিরাট অংশ হারিয়েছে রাশিয়ার কাছে। যুদ্ধ রাশিয়া ইউক্রেন হচ্ছে না, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান, রাশিয়া আক্রমণ করেছে আর ইউক্রেন ঠকিয়ে রাখার ”েষ্টা করছে পশ্চিমা অস্ত্রদানে এবং গোয়েন্দা সহযোগিতায়। গোলাগুলি, আক্রমণ যা হচ্ছে তা ইউক্রেনের অভ্যন্তরেই। রাশিয়া থেকে নিরাপদ থাকার জন্য ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিবে, পশ্চিমের কোলে আশ্রয় নিবে। কেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রাশিয়ার মনোভাব জানা সত্বেও এমন টোপ গিললেন ? জেলেনস্কি একজন ইহুদি এবং তার মন্ত্রীসভা ইহুদি প্রধান। ইহুদিদের সাথে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলির সখ্যতা সর্বজনবিদিত। তারাই ইসরাইলকে মধ্য প্রাচ্যে প্যালেস্টাইনীদের উচ্ছেদ করে বসিয়েছে এবং টিকিয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরকার যেমন ইহুদি লবি প্রাধান্য পাচ্ছে তেমনি ইহুদিরাও তার ডাকে সাড়া দেবে এটাই স্বাভাবিক। ওদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে সম্পৃক্ত হতে পারলে ইউক্রেন জাতে উঠবে এবং অভিজাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই জেলেনস্কির খায়েশ। এছাড়া রাশিয়ার সংগে ইউক্রেনের দিনকাল ভাল যাচ্ছিল না। ক্রিমিয়া দখল করা, দোনেস্ক ও লুহানস্কে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কে দেয়া ও স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া, স্থানীয় রুশদের উপর নীপিড়ন চালানোর জন্য রাশিয়ার আক্রোশ, রাশিয়ার গ্যাস লাইনের উপর অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপের বিষয়ে রাশিয়ার অসন্তষ্টি, এসব নিয়ে টানপোড়েন ও নিরাপত্তাহীনতা জেলেনস্কিকে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে সাহায্য করেছে।
রাশিয়াকে যুদ্ধে নামানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রাশিয়া এবং জার্মানীর মধ্যকার নর্ড স্ট্রিম-২ (Nord Stream-2) বন্ধ করা যা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য। এটি চালু হলে জার্মানীর সাথে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে জার্মানী ইউরোপের হাত ছাড়া হয়ে যাবে। জার্মানীর প্রয়োজন হবে না যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল ও ন্যাটোর সংগে থাকার। রাশিয়া তাতে আরো শক্তিশালী হয়ে যাবে। ১৯১২ সালে চালু হওয়া নর্ড স্ট্রিম-১ এর মাধ্যমে রাশিয়া ৫৫ বিলিয়ন ঘন মিটার গ্যাস সরবরাহ করে জার্মানীতে। গত সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত হওয়া নউ স্ট্রিম ২ চালু হলে এর দ্বিগুন গ্যাস সরবরাহ হবে। যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই এটি বন্ধ করতে চাপ দিলে জার্মানীরা তা গ্রহন করেনি। বিগত সরকারের চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল এই প্রস্তাবে রাজী না হওয়ার মার্কেলের সংগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না। বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাভ শুল্জ্ মার্কিন বান্ধব হওয়ায় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সংগে সংগেই নর্ডস্ট্রিম ২ বন্ধ করে দেন। যুক্তরাষ্ট্র ওলাভকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে রাশিয়ার কাছে ইউরোপ বা কেউ নিরাপদ নয় এবং পুতিন আগ্রাসী, নিষ্ঠুর, নব্য হিটলার ইত্যাদি। ওদিকে ইউক্রেনকে বাগে আনা রাশিয়ার প্রয়োজন ছিল। ইউক্রেনের ভিতর দিয়ে রাশিয়ার তৈল ও গ্যাস পাইপ লাইন ইউরোপে তৈল ও গ্যাস সরবরাহ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়ে গেলে ইউক্রেন এই লাইনের জন্য উচ্চহারে কর বসায় এবং তৈল-গ্যাস চুরিও করে। এছাড়া কৃষ্ণ সাগরকে নিয়ন্ত্রণ করাও রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটি বানিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল যোগাযোগের ক্ষেত্র। ওদিকে পশ্চিমের সাথে ভূরাজনৈতিকভাবে এটি বাফার জোন হিসেবে কাজ করবে। ইউক্রেন বা এই অঞ্চলে রাশিয়ার আরেকটি মিশন আছে। পুতিনের দার্শনিক ও আদর্শগত গুরু আলেকজান্ডার দুগিনের গ্রন্থঃ Foundations of Geo-Politics --- the Political Future of Russia-এর বাণী কার্যকর করা তার লক্ষ্য। তাতে ক্রিমিয়া, ইউক্রেন এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চল দখল করে পশ্চিমের রোমান ক্যাথলিক আদর্শের বিপরীতে অর্থডোক্স খৃষ্টান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ রয়েছে। ডুগিনের দর্শনের মাধ্যমে রাশিয়ার পুনুরুত্থান করার লক্ষ্য পুতিন গভীরভাবে পোষণ করেন। পুতিন নিজে অর্থডোক্স খৃষ্টান, রাশিয়ানরা সাধারণভাবে এই মতে বিশ্বাসী।
এত জটিল সমীকরণের মধ্যে এই যুদ্ধ বন্ধের সমাধান কি ? একটা সমাধানতো অবশ্যই হতে হবে, প্রত্যেক যুদ্ধের একটা শেষ আছে। ইউক্রেন রণমঞ্চেরও যবনিকাপাত হতে হবে। ইতোমধ্যে বিশ্ব এর কুফল ভোগ করা শুরু করেছে, ইউক্রেনও অস্ত্রভান্ডার ফুরিয়ে যাওয়ায় এবং দেশ ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কুটনীতি সচল রয়েছে। কিন্তু সন্ধির শর্তেতো দু’পক্ষেরই স্বপক্ষের ও বিপক্ষের জোরালো পয়েন্ট থাকতে হবে। ইউক্রেনের কি তা আছে ? তাই পশ্চিমারা চাচ্ছে আরো বেশী করে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করে ভূমি দখলে রাখা এবং রাশিয়াকে ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে ব্যস্ত রাখা যাতে শান্তি আলোচনার বসলে ইউক্রেনের কিছু জোরালো দাবী থাকে। হয়তো চরম পর্যায়ে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার মিসাইল দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আঘাত হানার ব্যবস্থা করা হবে। সেক্ষেত্রে রাশিয়াও চরম পন্থা গ্রহণ করবে যা সে ইতোমধ্যে একাধিকবার সতর্ক করে দিয়েছে এবং সেভাবে পারমানবিক মিসাইল মোতায়েন করেছে। রাশিয়া এর আগে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের বিরূদ্ধেও কড়া হুশিয়ারী দিয়েছে। এই যুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়া বাল্টিক সাগরে অত্যাধুনিক আন্তদেশীয় পারমানবিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র “সাটান ২” বা সারমাতের সফল পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করেছে যা ২০০ সেকেন্ডে বৃটেনকে এবং ১০ সেকেন্ডে ফিনল্যান্ডকে গুড়িয়ে দিতে পারবে। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা লক্ষ্য কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা বলা মুশকিল, তবে রাশিয়া হারবে না আর ইউক্রেনও কিছু পাবে না ধ্বংশ ছাড়া। তাই সংশ্লিষ্ট সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, এই যুদ্ধের অবসান হবে এবং বিশ্ব স্বস্তি পাবে এটাই সবার আশা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক