পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মৎস্য ও কৃষি বিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে। এরমধ্যে শুধু মৎস্য খাতেই বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া বরিশালে আমড়া, সুপারি, পেয়ারা, তরমুজ, মুগডাল, সরিষা, তিশি, শাক-সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধান চাষ হয়ে থাকে। সারাদেশে ইলিশের বড় জোগান আসে দক্ষিণাঞ্চল থেকে। উৎপাদিত ইলিশের ৬৬ ভাগ আসে এই অঞ্চল থেকে। এর বাইরে খুলনা, যশোর, নড়াইল, মেহেরপুরসহ পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলায় উৎপাদিত কৃষি ও মৎস্য ভান্ডারের একটি বড় অংশ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘদিন থেকে এসব পন্য ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় পাঠাতে সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিলো উত্তাল পদ্মা নদী। এবার সেই প্রমত্তা নদীতে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য স্থানান্তর প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়েছে। এতে এ অঞ্চলে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। প্রসার হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের। এমনটাই প্রত্যাশা করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাছ উৎপাদনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এগিয়ে থাকা বরিশালের মৎস্য সেক্টরে উন্নয়নের প্রধান বাঁধা ছিলো পদ্মা নদী। সেই নদীর ওপর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধণ হওয়ায় মৎস্য সেক্টরে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন এ অঞ্চলের মাছ ব্যবসায়ীরা। বরিশাল বিভাগের প্রায় ৩৮টি মোকাম থেকে প্রতিদিন অর্ধশতাধিকেরও অধিক মাছ বোঝাই ট্রাক রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তির ফেরি যুগের অবসান ঘটিয়ে পদ্মা সেতুর কারণে সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক উন্নয়নের ফলে রাজধানীতে পৌঁছতে সেই দুর্ভোগ ও সময় কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টায়। ফলে প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে উৎপাদিত মাছ অল্পসময়ের মধ্যে কাঙ্খিত বাজারে পৌঁছে ন্যায্য দাম পাবেন এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের (দালাল) দৌরাত্ম্যরোধের পাশাপাশি দেশ-বিদেশে নতুন বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বরিশালের ব্যবসায়ীরা দেশ-বিদেশে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারবে। এতে করে শুধু মৎস্য খাতেই বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৬৬ ভাগের জোগান দিয়ে থাকে বরিশাল বিভাগ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ৪ লাখ ৯৬ হাজার টন ইলিশের মধ্যে ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫ টন আহৃত হয়েছে বরিশাল বিভাগ থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরিশাল জেলায় উৎপাদিত ৪২ হাজার ৩৮৮ টন ইলিশ ছিলো, তা বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার টনে।
বরিশাল আঞ্চলিক মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ইলিশ ছাড়াও সবধরনের মাছ উৎপাদনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বরিশাল বিভাগ। গত অর্থবছরে এ অঞ্চলের ছয় জেলায় ইলিশসহ মোট উৎপাদিত অন্যান্য মাছের পরিমাণ ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৭ টন। এরমধ্যে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪০ টন মাছ দিয়ে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা হয়েছে, বাকি ২ লাখ ১৬ হাজার ১৫৭ টন মাছ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করা হয়েছে।
বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর জোমাদ্দার বলেন, অতীতে জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে তা দেশের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছাতে বেগ পেতে হতো। বর্তমানে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় অতীতের সেই ভোগান্তি আর নেই। তাই আমরা দেশ-বিদেশে নতুন বাজার খুঁজছি। কম সময়ে কাঙ্খিত বাজারে মাছ পৌঁছে দিয়ে মৎস্য খাতের ব্যাপক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছি।
বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে ইলিশ কম দামে ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা করতেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। এখন আর সেই সুযোগ থাকছেনা। অতীতে বরিশালের উপকূল থেকে একটি ট্রাক ঢাকায় পৌঁছাতে গিয়ে ফেরি পারাপার হতেই দুই থেকে তিনদিন সময় লাগত।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের কারণে এখন সর্বোচ্চ সাড়ে চার ঘন্টার মধ্যে মাছের ট্রাকগুলো রাজধানীতে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা মাছের গুণগত মান রক্ষার মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য আদায় করতে পারছেন। যেকারণে পদ্মা সেতুর বদৌলতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মৎস্য ও কৃষি বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।