কোরবানীর পশুর চামড়ার দাম নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা যা-ই হোক না কেন! বাস্তবতা হলো এই যে, ৯৯ লক্ষ ৫১ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে এবার পবিত্র ঈদুল আজহায়। প্রায় ২০ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ১ কোটি পশু কোরবানি নিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার উদাহরণ যেমন, তেমন ভয় পাওয়ারও বিষয়। আমাদের অর্থনীতিকে কারা কিভাবে ধ্বংস করেছে, তা আমি-আমরা কিন্তু জানি-অনুমান করি; কিন্তু বলি না। এবার পশু কোরবানীর প্রতিযোগিতা তারই একটা উদাহরণ নির্মাণ করেছে।
ঈদের আগে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কোরবানির পশুর হাট সাজাতে ইজারাদারদের ব্যস্ততা। এরইমধ্যে কারও কারও প্রস্তুতিও ছিলো সর্বোচ্চ চেষ্টা। সেই সর্বোচ্চ চেষ্টার হাত ধরেই ৬ জুলাই থেকে দ্বার খুলবে কোরবানির পশুর হাটের। এরপর বেচা-বিক্রি চলবে পাঁচদিন। যদিও হাটের সামনে থাকা সড়কের বেহাল দশা নিয়ে আমাদের মত দুশ্চিন্তায় ছিলো স্বয়ং মন্ত্রী-এমপিরা। আমাদের আশঙ্কা অনুযায়ী হাটগুলোর সামনের সড়কগুলোয় নির্মাণকাজ চলায় এবারের পশুর হাটে ভোগান্তি বেড়েছিলো। চামড়াশিল্প ধ্বংসপ্রায় আমাদের অর্থনীতিকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাবে আমি জানি না, তবে এতটুকু অনুমান করছি যে, জাতির রাজনৈতিক-প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালে লোভি বেড়েছে, বেড়েছে ছাত্র-যুব-জনতার অধিকার হরণের অনিমেষ প্রয়াস। উত্তরণে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে চাই- চামড়াশিল্পকে পরিকল্পিতভাবে শিল্পময় আগামীর কাতারে নিয়ে আসতে হবে এখনই। আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তির দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে বরাবরের চেয়ে এবার রাজধানী ঢাকার পশুর হাটগুলো ছিলো চরম রকম অস্থিতিশীল।
চলতি বছর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মোট ২০টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিলো। আসন্ন ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন স্থানে কোরবানির পশুর হাটের কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো। ঈদের অনেক আগেই সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছিলো- এবার রাজধানীর উত্তরে ১০টি এবং দক্ষিণে বসছে ১০ টি পশুর হাট বসবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে স্থানীয়ভাবে আর কোনো হাট বসানো যাবে না বলেও জানানো হয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনা না মানলে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন।
রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক শক্তিশালী ব্যক্তিরা রাজধানীতে পেয়েছে হাট ইজারা। উত্তর সিটিতে হাটের ইজারা পেয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ হলেন- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আওতায় উত্তরা ১৭নং সেক্টরের বৃন্দাবন হতে উত্তর দিকে বিজিএমইএ পর্যন্ত খালি জায়গায় কোরবানির পশুর হাটটি এক কোটি বিশ লাখ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন মো. নুর হোসেন। এই হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৬ লাখ ৬৬ হাজার ১২০ টাকা। ভাটারা (সাইদ নগর) পশুর হাটটি এক কোটি তিন লাখ ত্রিশ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন মো. সুরুজ্জামান। যার সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ২ লাখ ৪৬ লাখ ৬৬৭ টাকা। কাওলা শিয়াল ডাঙ্গা সংলগ্ন খালি জায়গায় পশুর হাটটি চব্বিশ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন মো. তৌফিকুর রহমান। এই হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯ লাখ ৫২ হাজার ৫২০ টাকা। বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং আফতাব নগরস্থিত ব্লক-ই, এফ, জি, এইচ পর্যন্ত; যা সাবেক বাড্ডা ইউনিয়ন পরিষদের অংশ এই পশুর হাটটি সর্বোচ্চ এক কোটি আটচল্লিশ লাখ তিপ্পান্ন হাজার টাকায় দরে ইজারা পেয়েছেন মিজানুর রহমান ধনু। যার সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৪৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। মোহাম্মদপুর বছিলাস্থিত ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গায় পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন মেসার্স শাহীন ইন্টারন্যাশনালের প্রো. মো. আমজাদ হোসেন। উনত্রিশ লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকায় হাটটি ইজারা পেয়েছেন তিনি। আর এই হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৬ লাখ ৬০ হাজার ৬০০ টাকা। মিরপুর গাবতলী পশুর হাট (স্থায়ী হাট) সর্বোচ্চ বার কোটি টাকা দরে ইজারা পেয়েছেন মোঃ লুৎফর রহমান। যার সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৬৬৭ টাকা। মিরপুর সেকশন-৬, ওয়ার্ড নং-০৬, (ইস্টার্ন হাউজিং) এর খালি জায়গার হাটটির ইজারা এখনও সম্পন্ন হয়নি। এই হাটটি ইজারার জন্য সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৬৬৭ টাকা। তবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৮২ লাখ ২৬ হাজার ৭৮৬ টাকা দর দিয়েছেন মো. কামাল হোসেন। ৪৩ নং ওয়ার্ডের ৩০০ ফুট সড়ক সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বের সালাম স্টিল ও যমুনা হাউজিং কোম্পানির এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন খালি জায়গার হাটটির ইজারা এখনও সম্পন্ন হয়নি। এই হাটটি ইজারার জন্য সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। তবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১ কোটি ১২ লাখ টাকা দর দিয়েছেন মো. রানা আহমেদ। ৪৪ নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত কাঁচকুড়া বেপারীপাড়ার রহমান নগর আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গার হাটটির ইজারা এখনও সম্পন্ন হয়নি। এই হাটটি ইজারার জন্য সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ লাখ (সাম্ভ্যব্য) টাকা। তবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দর দিয়েছেন মো. রুহুল আমিন। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর খেলার মাঠের খালি জায়গার হাটটির ইজারা এখনও সম্পন্ন হয়নি। এখন পর্যন্ত কেউ এই মাঠটি ইজারা নেওয়ার ইচ্ছে পোষন করেনি। তবে এই হাটটি ইজারার জন্য সরকারিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৭ টাকা।
উত্তরের মত দক্ষিণ সিটিতেও দেখা গেছে রাজনৈতিক বিবেচনায় পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন- উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজার সংলগ্ন আশ-পাশের খালি জায়গায় পশুর হাটটি ১ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন এ এম এম এন্টারপ্রাইজের প্রো. মো. আবদুল লতিফ। যার সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ২২ লাখ ৬০০ টাকা। ইনস্টিটিউট অফ লেদার টেকনোলজি কলেজ সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা পশুর হাটটি ৩ কোটি ৪১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৫ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন অহিদুর রহমান ওয়াকিব। এই হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৫২ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ টাকা। পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন আশ- পাশের খালি জায়গায় পশুর হাটটি ২,২০,৫০,০০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন মো. মঈন উদ্দিন চিশতী। যার সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১,৩৭,৮১,৭৬৭ টাকা। খিলগাঁও মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন আশ-পাশের খালি জায়গা পশুর হাটটি সর্বোচ্চ ১,৯০,০০,০০০ টাকা দরে ইজারা পেয়েছেন মো. আওরঙ্গজেব টিটু। এই হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১,৮৭,৬৭,৩০০ টাকা। লিটন ফ্রেন্ডস ক্লাব সংলগ্ন খালি জায়গা ও কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশ-পাশের খালি জায়গা পশুর হাটটি ৩,১৩,০০,০০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন খান ট্রেডার্স প্রো. গোলাম কিবরিয়া খান। হাটটির সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২,৬৭,১২,০০০ টাকা। যাত্রাবাড়ির দনিয়া কলেজ সংলগ্ন আশ-পাশের খালি জায়গা পশুর হাটটি ৪,৪০,০০,০০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন মো. গিয়াস উদ্দিন গেসু। যার সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২,৮৭,২৬,৮৩৩ টাকা। ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকায় পশুর হাটটি ৪,০০,০৫,০০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন মো. আনোয়ার। এই হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২,৭০,৩১,০৬০ টাকা। আমুলিয়া মডেল টাউন এর আশ-পাশের খালি জায়গায় পশুর হাটটি ৩৫,০০,০০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন নওশের আলী। এই হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২১,৪৬,৫০৩ টাকা। লালবাগের রহমতগঞ্জ ক্লাব সংলগ্ন আশ-পাশের খালি জায়গায় পশুর হাটটি ৫০,১০,০০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম। হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৮,২৬,৬০০ টাকা। শ্যামপুর কদমতলী ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন খালি জায়গায় পশুর হাটটি ৬৩,৫০,০০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরে ইজারা পেয়েছেন শেখ মাসুক রহমান। এই হাটের সরকারী মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৪,০৬,০০০ টাকা।
শুধু রাজধানী ঢাকা নয়; আমাদের রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশে সকল পশুর হাট-ই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে থাকায় এবার পশুর হাটে বেড়েছে কোরবানীর পশুর দাম। কিন্তু তারপর? কোরবানি হয়ে যাওয়ার পর যারা কোরবানীর পশুটির চামড়া বিক্রি করতে চেয়েছেন, পেয়েছেন সর্বনিন্ম দাম। এমন একটি পক্রিয়ার কারণে চামড়াশিল্প পড়েছে চরম শঙ্কার মধ্যে। উত্তরণে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস যেমন ছিলো না, তেমনি ছিলো না আমাদের চামড়াশিল্পকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কোন কার্যকর পদক্ষেপ। আশা করি প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই দেশে, বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ¦ালানি তেলসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বস্তুর বৃদ্ধির দেশে সরকারের উচিত ছিলো চামড়াশিল্পকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে সহজতর পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখা...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি।