সুস্থ দেহে সুন্দর মন। শরীর ও মন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুস্থ শরীরেই সুন্দর মনের বসবাস। শরীর অসুস্থ হলে মনও অসুস্থ হয়। আবার শরীর যেমন অসুস্থ হয় তেমনি মনও অসুস্থ হয়। এ পৃথিবীতে যত রোগী আছে এর মধ্যে অধিকাংশ রোগীই মানসিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ মানসিক সমস্যার কারণে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মনের সুস্থতার সঙ্গে জড়িত হলো মানসিক স্বাস্থ্য। মানসিক স্বাস্থ্য বলতে মনের অবসাদ, বিষণœতা, সমস্যা কাটিয়ে ওঠার মানসিক শক্তি ইত্যাদি বিষয়কে বোঝায়। সহজভাবে বললে, মানসিক স্বাস্থ্য হলো আমাদের মনের, আচরণের ও আবেগপূর্ণ স্বাস্থ্যের দিকটি। অর্থাৎ আমরা কি চিন্তা করি? কি অনুভব করি? জীবনকে সামলাতে কিরকম ব্যবহার করি এগুলোই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন অনুসারে, মানসিক সুস্থতা বলতে ভালোর একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তি তার নিজস্ব দক্ষতা উপলব্ধি করে, জীবনের স্বাভাবিক চাপকে মোকাবেলা করতে পারে এবং উৎপাদনশীল ও ফলদায়কভাবে কাজ করতে পারে। জীবনে চলার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই কম-বেশি মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। এই মানসিক চাপকে কীভাবে মোকাবেলা করে সুস্থতার সঙ্গে বেঁচে থাকা যায় তাই মানসিক সুস্থতা। যদি কোনো ব্যক্তি মানসিক চাপকে ভালোভাবে সামলে নিতে না পারেন, তাহলে সে হতাশায়, বিষণœতায় ভোগেন। আর এই হতাশা, বিষণœতাই নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান প্রজন্মের জন্য হতাশা, বিষণœতা এক বিরাট সমস্যার নাম। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৩০ সালে বিষণœতা মানুষের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ২০১৮-১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭% বা ২ কোটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ১০০ জনের মধ্যে ৭ জন ভুগছেন বিষণœতায়। পাশাপাশি এই পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, ৯২%-ই রয়েছেন চিকিৎসার আওতার বাইরে। অন্যদিকে ১৩.৬% শিশু ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। বর্তমানে যদি জরিপ করা হয়, তাহলে এই পরিসংখ্যানটা বৃদ্ধি পাবে ছাড়া কমবে না। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে ব্যক্তি সহজেই রাগান্বিত হয়, বিষণœতায় ভোগে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। আর বেশি রাগ আমাদের লিভারকে প্রভাবিত করে, শোক কিংবা দুঃখ ফুসফুসকে দুর্বল করে দেয়, দুশ্চিন্তা করলে হজমের শক্তি কমে যায়, সার্বিক এ চাপগুলো রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। মানসিক স্বাস্থ্যের চূড়ান্ত অবনতি ঘটলে মানুষ আত্মহত্যা করার চিন্তা-ভাবনা করে। আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৭৯ জন। আবার ২০২১ সালে ২৫৫২ জন শিক্ষার্থীর ওপরে একটি জরিপ চালায় আঁচল ফাউন্ডেশন। এতে দেখা যায়, গ্রামের ৮৬ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী বিষণœতায় আক্রান্ত। শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই হার ৮৪ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান-ই বলে দেয়, আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অবহেলিত। বিশেষজ্ঞরা অভিমত পোষণ করেন, মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখার মাধ্যমে আত্মহত্যা ও মানসিক সমস্যা কাটিয়ে ওটা সম্ভব। আমাদের সমাজের মানুষের কিছু বদ্ধমূল ধারণার মধ্যে একটি হলো- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার রোগীদের পাগল বলা। এমকি দেখা যায়, ওদের পাগল বলে সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়। এজন্য অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে চেপে রাখেন এবং ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে চান না। বাংলাদেশে যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তাদের ভাষ্যমতে, কিছু বদ্ধমূল সামাজিক ধারণার কারণে এখনো অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে পেশাদার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না। এক গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন এমন প্রতি দুই লাখ মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন মাত্র ১ জন। আবার এর মধ্যে প্রায় শত ভাগই শহর পর্যায়ের হাসপাতালে কিংবা ক্লিনিকে রয়েছেন। যা মানসিক চিকিৎসকের অপ্রতুলতাকে নির্দেশ করে। মানসিক বিশেষজ্ঞদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে মানসিক রোগী ভাবার মতো বদ্ধমূল ধারণাগুলো বদলাতে হবে। সে ক্ষেত্রে, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যেমন- সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন আমাদের মনকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে বই পড়া, খেলাধুলা, সংগীত, কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা ইত্যাদি নিজ সংস্কৃতিচর্চা করার অভ্যাস গঠন করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায় থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। যাতে মানসিক সমস্যাকে পাগলের সঙ্গে তুলনা না করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে হতাশা, বিষণœতা এবং আত্মহত্যার যে প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি জোর দিতে হবে। সর্বোপরি, সুস্বাস্থ্যের সুন্দর আবহ রক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অনিবার্য।