শ্রাবনের তাপমাত্রার পারদ যেন আর কোনোভাবেই কমছে না। সূর্য ওঠার পরপরই চড়চড় করে বাড়ছে তাপমাত্রার পারদ। টানা দুই সপ্তাহের তীব্র তাপদাহে জয়পুরহাটের কালাইয়ের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র রোদ আর ভ্যাপসা গরমের বাতাস সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন কম। যদিওবা কেউ বের হচ্ছেন, তবে ছাতা ব্যবহার করে আসছেন ঘরের বাইরে। এতে চরম দূর্ভোগে পোহাতে শিশু ও বয়স্কদের। বৃষ্টিহীন প্রখর রোদের সাথে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে শিশু শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। তীব্র খড়তাপে দিন মজুর অটোভ্যান ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার অনেকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রচন্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে কাজে বেড়িয়েছেন শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কোথাও স্বস্তির বাতাস নেই। বাতাস বইছে না। গাছের পাতাও নড়াচড়া করেনা। সর্বত্র গরম আর গরম, কখনও তীব্র, আবার কখনও ভ্যাপসা গরম। প্রশান্তির বৃষ্টির জন্য চারিদিকে শুধু এখন হাহাকার পড়ে গেছে। নেট থেকে তথ্য পাওয়া গত দুই-সপ্তাহ ধরে উপজেলায় তাপমাত্রা গড়ে ৩৬ ডিগ্রী ওঠানামা করছে। সামনে আরো তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জীব-বৈচিত্রের উপরও। এমন প্রচন্ড গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে গোটা কালাই উপজেলাবাসীর।
উপজেলায় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রোদের প্রখরতায় সদরে ছিল না তেমন কোন মানুষজন। চলাচল করতে কম দেখা গেছে বিভিন্ন যানবাহন। পথচারীরা কলের পানিতে মুখ ভিজিয়ে আগ্নিকুন্ড থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। সেখানেও স্বস্তি নেই, কল দিয়েও গরম পানিই বের হচ্ছে। গরমে একটু জিরিয়ে নিতে কেউবা গাছের তলা, কেউবা ভবনের নিচে আবার কাউকে ডাবের পানি, লেবুর শরবত ও আখের রস খেতে দেখা গেছে। একটু শীতলতার জন্য শিশু-কিশোর সকলেই পুকুর ও বিলে ছোটাছুটি করছে। তীব্র তাপদাহে কয়েকদিনে হাট-বাজারে মানুষের সমাগম কমে গেছে। এ গরমে বৃষ্টির অভাবে উপজেলার কৃষকরা আমন ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম হলেও জমিতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় আমনের চারা রোপণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তবে অনেকে বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ প্রদানের মাধ্যমে রোপা আমন ধানের চারা রোপণ শুরু করেছেন। এদিকে তীব্র গরমে বেড়েছে সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া ও জ¦রে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধা-বৃদ্ধদের সংখ্যা বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এই সুযোগে এসি, টেবিল ফ্যান ও সিলিং ফ্যান প্রচুর পরিমান বিক্রি হয়েছে। এই গরমে দাম বেড়েছে ডাব ও তরল জাতীয় খাবার। প্রতিটি ডাবের দাম বেড়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, প্রতি কেজি তরমুজের দাম বেড়েছে ৩০টাকা, প্রতিটি আখের রস ও লেবুর শরবতের গ্লাসের দাম বেড়েছে ১০টাকা।
কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা বেহুল বলেন, অসহনীয় গরমে আমার দুই সন্তানের কয়েক দিন যাবত জ¦র, সর্দি ও কাশি হয়েছে। তাই এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি।
কালাই বাসস্ট্যান্ডে এলাকায় বাদাম বিক্রেতা সাইর উদ্দিন বলেন, তীব গরমে সদরে মানুষজন তেমন নেই। ১০ কেজি ভাজাবাদাম এনেছিলাম। সারাদিনে কোনমতেই ২ কেজি বাদাম বিক্রি করতে পেড়েছি। এখন আমাদের উপার্জন অনেক কমে গেছে।
উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়ন সদরে ভ্যান চালক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কয়েক দিন থেকে যে তাপ উঠছে ভ্যান নিয়ে পাকা রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছে না। গরমে চাকা বার বার পানচার হচ্ছে। এই গরমের মধ্যে ভাড়া বাড়লেও যাত্রী অনেক কমে গেছে। জানি না এ রকম প্রখর রোদ আর কত দিন থাকবে।
উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের আবদুস সাত্তার নামে এক দিনমজুরি বলেন, জীবন-বাঁচার তাগিতে আমি অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি দিয়ে ৫ সদস্যর সংসার চালাই। গত কয়েকদিন ধরে এত তাপদাহ সহ্য করার মত নয়। পেটে খেলে সব কিছুই সহ্য করতে হয়। তাই প্রচন্ড গরমেই সারাদিন দিনমজুরির কাজ করছি।
উপজেলার বেগুন গ্রামের ৭২ বছর বয়সী হাফিজার রহমান নামে এক বৃদ্ধা বলেন, গরম প্রতি বছর কম বেশি হয়ে থাকে কিন্তু এবার গরম আমার বুদ্ধি বয়সে এ রকম গরম আগে কখনো অনুভব হয়নি। এরকম গরম যদি থাকে তাহলে বাচা অনেক কষ্ট হবে।
উপজেলার পুনট ইউনিয়নের কৃষক এনামুল হক বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় গরমে মাঠগুলো শুকে ফেটে গেছে। পানির অভাবে মাঠে চাষ করতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ মাধ্যমে রোপা আমন ধানের চারা রোপণ শুরু করেছি।
সিঙ্গার কম্পানির কালাই উপজেলার শাখার ম্যানেজার মো. হাফিজার রহমান বলেন, গতকয়েক দিনে আমরা প্রায় ২শ এসি ও ২ হাজার ফ্যান বিক্রি করা হয়েছে। এর কারণ মুল হচ্ছে এই উপজেলায় প্রচন্ড গরম বয়ে যাচ্ছে।
কালাই উপজেলার কৃষি অফিসার নীলিমা জাহান বলেন, এই উপজেলায় চলতি মৌসুমে এগারো হাজার ৮শ ৫০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আষাঢ় মাস শেষ শ্রাবণ মাস শুরু হলেও আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় রোপা আমন চাষে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এজন্য গভীর নলকুপের মাধ্যমে কৃষকদের সেচ দিতে বলা হচ্ছে। অনেক জায়গায় গভীর নলকূপ চালু করে কৃষকরা জমিতে সেচ দিয়ে চাষ শুরু করেছেন।
কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. মো. জুয়েল হোসেন বলেন, গত কয়েক দিন থেকে প্রচন্ড গরমের কারণে ঘরে ঘরে ডায়রিয়া, জ¦র, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই। এসব রোগে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে এই হাসপাতালের আউট ডোর ও ইনডোরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এই গরমে সুস্থ থাকতে হলে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া যাবেনা। গরমের অনুভব বেশী হলে বেশী বেশী করে পানি, স্যালাইন পানি, ডাবের পানি বা তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে।