১৯৩৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার টাউনশ্রীপুরে জন্মেছিলেন এক ক্ষনজন্মা পুরুষ ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। যার নেতৃত্বে দেবহাটার মুক্তিযোদ্ধারা খুজে পেয়েছিলেন যুদ্ধের রনকৌশল আর যুদ্ধ জয়ের প্রশান্তি। তিনি দেশ মাতৃকার টানে এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের প্রেরনা যুগিয়েছিলেন। আর ১৯৯৩ সালের ২৩ জুলাই শিক্ষকতা করাকালীন এই মহান মানুষটি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তার অপরিসীম কাজের নিদর্শন। যা আজও দেবহাটা তথা সাতক্ষীরা সহ দেশের মানুষ অবগত আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার, বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারন জনমানুষের বন্ধু দেবহাটার কৃতী সন্তান ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। সমগ্র দেবহাটা ছিল ৯ নং সেক্টরের অর্ন্তভুক্ত। এই ৯ নং সেক্টরের আওতায় ৩ টি সাব-সেক্টর গঠন করা হয়। তার মধ্যে প্রথম সেক্টরটি ছিল শমসের নগর। যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা। দ্বিতীয়টি হেঙ্গলগজ্ঞ ও তৃতীয়টি ছিল টাকী। টাকী ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। বাংলাদেশের ১১ টি সেক্টরের মধ্যে ৯ নং সেক্টরটি ছিল সর্ববৃহৎ। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের উদ্যোগেই ভারতের টাকীতে গড়ে তোলা হয় ৯ নং সেক্টর। সেজন্য তাকে ৯ নং সেক্টরের প্রতিষ্টাতা ও সাব সেক্টর কমান্ডারের খেতাব দেয়া হয়। সমগ্র দেবহাটা থানা ৯ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। শাহজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বেই এই অঞ্চলের যুবকেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। তখন দেবহাটা এলাকার খানজিয়া ক্যাম্প, দেবহাটা ক্যাম্প, টাউনশ্রীপুর ক্যাম্প, সখিপুর ক্যাম্প, পারুলিয়া ক্যাম্প, কুলিয়া বাজার ও পুষ্পকাটি ইটের ভাঁটা সহ বিভিন্ন এলাকায় পাক সেনারা ঘাঁটি গড়ে তোলে। দেবহাটা এলাকায় টাউনশ্রীপুর ফুটবল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এক রাজাকার পাক সেনাদের কাছে পৌছে দেয়। ফলে পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বিষয়টি ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার বুঝতে পেরে অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্থ হয়। এই যুদ্ধে বহু পাক সেনা নিহত হয়। এ ছাড়া ভাতশালা সহ বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। ভাতশালা যুদ্ধের শেষের দিকে হঠাৎ একটি বুলেট এসে মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের মাথায় লাগে। সেখানেই তিনি নিহত হন। একপর্যায়ে টাউনশ্রীপুরের সেনা ঘাটির পতন হয়। তখন প্রধান সেনাপতি এম.এ জি ওসমানী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদ ও সেক্টর কমান্ডার এম.এ জলিল সকলে মিলে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারকে নিয়ে বিজয় উল্লাস করেন। এখান থেকে পাক সেনারা যাওয়ার সময় শাহজাহান মাষ্টারের বাড়ি কেরোসিন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়। এরপরে অক্টোবর মাসে খান সেনারা খাঁনজিয়া ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। তারা যাওয়ার সময় ঐ এলাকায় এ.পি মাইন পুতে রেখে যায়। ঐ মাইনগুলো অপসারন করতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওহাব শহীদ হন। পরে পারুলিয়া, সখিপুর ও কুলিয়া সহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্থ হয়। তারা চলে যাওয়ার সময় বহু মানুষের ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেয় এবং পারুলিয়া ব্রীজ ধ্বংস করে দেয়। ১৯৮৫ সালের প্রথম উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি দেবহাটার অসংখ্যা উন্নয়নমূলক কাজ করেন। দেবহাটা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গনে তিনি অসংখ্যা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন। সেসময় অনেকে তার কাছে জিজ্ঞাসা করতেন, “স্যার এত গাছ লাগিয়ে কি হবে”। উত্তরে তিনি বলতেন, “একসময় আমি থাকবোনা, কিন্তু এই গাছগুলো থাকবে”। সত্যিই তার লাগানো গাছগুলো আজও তার স্মৃতির সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সেসময় তিনি সমাজের অসহায় মানুষদের কল্যাণেঅনেক কাজ করার পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন। তিনি সখিপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করাকালীন হঠাৎ হ্নদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৩ সালের ২৩ জুলাই মৃত্যুবরন করেন। শনিবার ২৩ জুলাই তার স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার স্মৃতি সংরক্ষন কমিটির ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে কোরআন খতম, আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল ও তাবারক বিতরন। অনুষ্ঠানে সকলকে আসার জন্য ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের পরিবারবর্গ ও ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার স্মৃতি সংরক্ষন কমিটির নেতৃবৃন্দ অনুরোধ জানিয়েছেন।