দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকায় ও মামলা-হামলায় এমনিতেই নাজুক অবস্থা জেলা বিএনপি’র। জেলা বিএনপি’র এমন অবস্থা দেখে অনেকটাই নিস্ক্রিয় হয়েছিল উপজেলা বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল শক্তিশালী করার দিকে নজর দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি)। সেই নিরিখে জেলা সম্মেলনের পূর্বে শেরপুর উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলনকে ঘিরে বেশ সরব হয়ে উঠেছে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী ও তাদের অনুসারীরা। তবে স্থানীয় বিএনপির নেতা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা জল্পনা-কল্পনা ও চুলছেড়া বিশ্লেষন চলছে হরদম। স্থানীয়ভাবে নিজেদের আধিপত্য ও অস্থিত্ব ঠিক রাখতে উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলনকে ঘিরে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নেতাকর্মীরা। এতে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সংকটের। কে হচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক তা নিয়ে দলের ভিতরে চলছে নানা কানাঘুষা পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থন ও মৌন ভোটাভুটি। এসব নানা সংকট নিয়ে উপজেলা বিএনপি সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে উঠতে সম্মেলনমুখি হয়ে পড়েছে দলটির সংশ্লিষ্ট স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
দীর্ঘ ১৪ বছর পর আগামী ৩০ জুলাই বগুড়ার শেরপুর উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগে ২০০৯ সালে শেরপুর উপজেলা বিএনপি’র সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল। উপজেলার গাড়িদহ মডেল ইউনিয়নের মহিপুর খেলার মাঠে অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলনকে সফল করতে উপস্থিত থাকবেন জেলা বিএনপি আহ্বায়ক ও বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা। থাকবেন জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট একেএম সাইফুল ইসলাম, ফজলুল বারী তালুকদার বেলাল, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য জয়নাল আবেদিন চাঁন প্রমুখ সহ জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার নেতারা। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শহিদুল ইসলাম বাবলু।
এদিকে উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলনকে ঘিরে সাজসাজ রব সহ ইতোমধ্যে স্থানীয় বিএনপি’র নেতাকর্মীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি প্যানেলে পরিণত হয়েছে। দুটি ধারায় বিভক্ত নেতাকর্মীরা তাদের আস্থা ও পছন্দের নেতা নির্বাচন করতে বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বিএনপিতে দুটো ভাগের মধ্যে বগুড়া জেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক ও বর্তমান সাংসদ জিএম সিরাজ গ্রুপ। আরেক গ্রুপের নেপথ্যে রয়েছে বিএনপি থেকে বহিস্কৃত নেতা শেরপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র জানে আলম খোকা ও তার সমর্থিতরা।
বিএনপি নেতা জানে আলম খোকা দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত করে পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছিলেন বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। তবে এ নিয়ে জানে আলম খোকা বিএনপি দল থেকে দুইবার বহিস্কার হয়।
এদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত হয়ে পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে জানে আলম খোকা জয়লাভ করলেই তার সমর্থিত নেতাকর্মীরা কর্মচাঞ্চলতা ফিরে পেয়ে স্থানীয় রাজনৈতিতে বেশ সরব হয়ে উঠেছে। তাদের পছন্দের নেতা(বহিস্কৃত নেতা জানে আলম খোকা)কে দলে ফেরাতে গোপনে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতেও কমতি রাখছেনা তার শুভাকাঙ্খী ও অনুসারীরা। উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে খোকা অনুসারীরা তাদের নিজেদের অস্থিত্ব ও আধিপত্য ঠিক রাখতে রাজনীতির মাঠে বেশ উঠেপড়ে লেগেছে। এদিকে আরেকটি পক্ষ এর বিপরীতমুখী মনোভাব নিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রেখে আগামী দিনে রাজনীতির মাঠ চাঙ্গা করতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। গঠন করে যাচ্ছেন বিএনপি সহ অঙ্গসংগঠনের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ ও আহ্বায়ক কমিটি। কি হবে অনুষ্ঠেয় উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলন স্থলে! তাছাড়া বিএনপি’র এ সম্মেলন নিয়ে উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সদস্য সচিব পিয়ার হোসেন পিয়ার ও কেন্দ্রীয় নেতা কেএম মাহবুবার রহমান হারেজের ভূমিকা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ার মতো অবস্থানে রয়েছেন। কি ধরণের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় রয়েছেন নেতাদ্বয় ও তাদের অনুসারীরা। এমন নানা হিসাব-নিকাশ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে মতামত পৌছাতে অনেকটাই হিমসিম খাচ্ছেন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দীর্ঘদিন ধরে শেরপুর উপজেলা ও শহর বিএনপি’র পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় চলমান রাজনীতিতে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বার উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি নিয়েই চলে আসছিল স্থানীয় রাজনীতি। এরমধ্যে বহিস্কৃত নেতা জানে আলম খোকাও আহ্বায়ক কমিটি প্রধান ছিলেন। তিনি দল থেকে বহিস্কার হওয়ার আগে বিগত ২০২০ সালের ১২ জুলাই উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি শফিকুল আলম তোতাকে আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কেএম মাহবুবার রহমান হারেজ কে যুগ্ম আহবায়ক। এরপর ২০২২ সালে ১২ জুলাই সেই আহ্বায়ক কমিটি পূর্ণগঠনকল্পে আবার উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি শফিকুল আলম তোতাকে আহ্বায়ক ও বিএনপি নেতা আবদুল হাই সিদ্দিকী হেলাল কে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ৪১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেন জেলা বিএনপি। স্থানীয় বিএনপি’র নানা সমস্যা ও সংকট থেকে উত্তরণ পূর্বক রাজনীতির মাঠ গরম করতে তৃনমূল ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করার মুখ্য উদ্দেশ্যে তোরজোর শুরু করেছে স্থানীয় আহ্বায়ক কমিটি।
নিজেদের পছন্দের ও ত্যাগীনেতাদের যোগ্য আসন বিন্যাশের মাধ্যমে এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ৯০টি ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করেন। প্রতিটি কমিটিতেই ৭১জন সদস্য রয়েছে। এছাড়াও শেরপুর পৌর কমিটিতে বিএনপি নেতা আলহাজ¦ ইছাহাক আলীকে আহ্বায়ক ও মাহবুবুল আলম হিরুকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ৩১ সদস্য কমিটি গঠন করা হয়। পৌর আহ্বায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দের সম্বনয়ে পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড কমিটি গঠনও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আগামী ৬ আগস্ট শেরপুর পৌর বিএনপি’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হাই সিদ্দিকী হেলাল।
এদিকে উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলন কেন্দ্র করে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এক ভাগে উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবলু সভাপতি, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মিন্টু সাধারণ সম্পাদক, শফিকুল ইসলাম শফিক ও আবদুল মমিন সাংগঠনিক সম্পাদক পদে। আরেক গ্রুপে সভাপতি পদে বিএনপি নেতা শাহ আলম পান্না, সাধারণ সম্পাদক পদে শফিকুল ইসলাম আরফান, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে হাসানুল মারুফ শিমুল ও আরিফুর রহমান মিলন। প্রার্থীরা তাদের বিভিন্ন প্রতীক নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির কাউন্সিলরসহ নেতাকর্মীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও গভীর রাত পর্যন্ত ধর্ণা দিচ্ছেন।
জেলা বিএনপি আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও শেরপুর উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবলু বলেন, বিএনপি একটি গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বড় দলে নেতা নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় স্থানীয় নেতাকর্মীদের। তবে আগামীদিনের সম্মেলনে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের বেছে নিয়ে রাজনৈতিক মাঠ আরো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করবে বলে আমরা বিশ^াস করি।
তবে যাই হোক, ৩০ জুলাই উপজেলা বিএনপি’র সম্মেলনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীন কোন্দল মিটিয়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতারাই যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত হোক। সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে উঠে আগামীদের রাজনৈতিক মাঠ সুগম হোক। ফিরে আসুক সুশৃঙ্খল ও গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক অবস্থান। এমনটাই প্রত্যাশা উপজেলার তৃণমুল বিএনপি নেতাকর্মী, অনুসারী ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের।