যেসব পণ্য ও কাঁচামাল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা হয় সেগুলোর স্থানীয় দামের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দামের একটা প্রভাব থাকে। তাই কোনো সময় কোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায় এবং শেষ পরিণতিতে ভোক্তাকে তা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে স্থানীয় বাজারে সেই অনুপাতে এর প্রভাব পড়তে দেখা যায় না। বরং জ¦ালানি তেলের ক্ষেত্রে এর উলটোটাই দেখলাম আমরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ¦ালানি তেলের দাম বারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম নেমে আসে ৯৩ দশমিক ৮১ ডলারে, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সর্বনিম্ন। অথচ গত শুক্রবার বাংলাদেশে জ¦ালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অকটেনের ক্ষেত্রে এ দাম বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ, প্রায় ৫২ শতাংশ। ডিজেলের ক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধির এই হার অযৌক্তিক ও অকল্পনীয়। সরকার হঠাৎ করেই সব ধরনের জ¦ালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে; পেট্রোলের দাম ৮৬ থেকে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এ হার দেশে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন হলো-এভাবে রাতারাতি জ¦ালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি করা কতটা যৌক্তিক? উদ্বেগজনক হলো, তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যখন নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, দেশব্যাপী লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানায় উৎপাদনে ধস নেমেছে, ঠিক তখন জ¦ালানি তেলের পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এই তোড়জোড় মোটেই কাম্য নয়। ইতঃপূর্বে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, জনগণের দুর্ভোগ হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না। অথচ যে হারে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠবে। ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে গণপরিবহণ ভাড়াসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম। আশ্চর্যজনক হলো, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত সাধারণত সপ্তাহের শেষদিনে নেওয়ার কথা। কিন্তু সরকার হঠাৎ করে বন্ধের দিন গভীর রাতে সব ধরনের জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে, যা একটি বিরল ঘটনা। দেশের মানুষ যখন তীব্র মূল্যস্ফীতির সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করছে, তখন জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি তাদের এ লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুত জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কৃষি ও শিল্প উৎপাদনসহ জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করবে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি থমকে যাওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে আয় কমেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। এ অবস্থায় জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যে বিপর্যয় নেমে আসবে, তা বলাই বাহুল্য। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে তেল-গ্যাসসহ সব ধরনের জ¦ালানির দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা জরুরি। আমরা মনে করি, তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা থাকা উচিত।