বাগেরহাটে অন্ধত্বকে জয় করে ব্যাচালর অব আর্টস (বিএ) পাস করেছেন আবু মূসা আল মামুন নামের এক যুবক। সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। অংশগ্রহণ করেছেন মৌখিক পরীক্ষায়, স্বপ্ন এখন শিক্ষক হওয়ার।
৩৪ বছর বয়সী আবু মূসা আল মামুন বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার এলাকার কুঠিবাড়ি-কাঠালতলা এলাকার বাসিন্দা। বাবা মোঃ দেলোয়ার হোসেন তৃতীয় বিয়ে করে আলাদা থাকায়, মা রওশনআরা বেগম, বড় বোন, স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে আবু মূসা আাল মামুনের সংসার। নিজের পড়াশুনা ও সংসারের ব্যয় বহন করেন প্রাইভেট টিউশনি করে। অন্ধ হওয়া স্বত্ত্বেও দিনের বেশিরভাগ সময় প্রাইভেট পড়িয়ে কাটে তার। পাশাপাশি মোবাইল ও কম্পিউটার চালনা দক্ষতা রয়েছে তার। হারমুনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেও পারেন তিনি। ৬ষ্ঠ থেকে এইসএসসি পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির ২০ জনের উপরে শিক্ষার্থী রয়েছে তার। সবাই বাড়ি এসে পড়েন। শিক্ষার্থীদের টাকায় কোন মতে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে দিন যায় মামুন ও তার পরিবারের সদস্যদের। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় নতুন করে আশার আলো দেখছেন মামুন ও তার পরিবার। স্থানীয়দের চাওয়া মামুনের চাকুরী হোক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আবু মূসা আল মামুন বলেন, জন্মের পর থেকেই আমি সামান্য দেখতাম চোখে। যার ফলে সবাই অন্ধ বলে উপহাস করত। ছোটবেলায় বাবা-মা বাড়িতে বসে অন্যান্যের পড়ালেও আমাকে কখনও হাতে ধরে তারা পড়াননি। প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাবা-মায়ের আদর পাইনি। সকল বাঁধা ও যন্ত্রনাসহ্য করে২০০৪ সালে মোরেলগঞ্জ এসিলাহা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করি। ২০০৬ সালে একই উপজেলার এসএম কলেজ থেকে এইসএসসি। তখনও চোখে আবছা আবছা দেখতাম। পরবর্তীতে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে খুলনা বিএল কলেজে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেনিতে ভর্তি হই। সফলতার সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ পাশ করি। হঠাৎ করে একদিন আর চোখে দেখতে পাই না। চিকিৎসক এবং কলেজের শিক্ষকদের পরামর্শে বাড়িতে ফিরে আসলাম। বিএ ভর্তির জন্য এসএম কলেজে যাই। কিন্তু অন্ধ হওয়ায় ভর্তি নেননি শিক্ষকরা। কয়েক বছর ঘুরে উপাচার্যের মৌখিক অনুমতিতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ ভর্তি হই। ২০১৫ সালে বিএ পাস করি।
মামুন আরও বলেন, বিএ পাস করলেও কোথাও কোন কাজ আমি পাই না। কারণ অন্ধকে কেউ কাজ দেয় না। তাই প্রাইভেট পড়াই। শিক্ষার্থীরা খুশি আমার পড়ানোয়। ওদের পড়িয়েই সারাদিন কেটে যায়। ওদের টাকায়ই সংসার চলে। ৬জনের সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়, তারপরও কোন উপায় নেই আমার। প্রাইভেট না পড়ালে পরিবারের কারও মুখে ভাত উঠবে না। এর বাইরে মোবাইল ও কম্পিউটারের মাধ্যমে ইউটিউব এবং গুগলে পড়াশুনা করি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়াশুনার জন্য যেসব সফটওয়ার রয়েছে সেগুলোতেও পড়ি আমি। প্রাথমিকের লিখিত পরীক্ষায় টিকেছি, মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছি। আল্লাহ যদি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে এমএও ভর্তি হব।
মামুনের প্রতিবেশী বৃদ্ধ মোঃ মুরাদ হাওলাদার বলেন, মামুনের তো বাবা থেকেও নেই। তার উপর বড় বোন, মাসহ ৬জনের সংসার সামলাতে হয় মামুনকে। ওর যদি প্রাইমারীতে চাকুরী হত, তাহলে পরিবারটা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারত।
মোরেলগঞ্জ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেনির শিক্ষার্থী জান্নাতুন নেছা ইভা বলেন, ৫ম শ্রেণি থেকে মামুন স্যারের কাছে পড়ি। স্যার যখন পড়ায়, তখন মনে হয় না যে স্যার চোখে দেখেন না। স্যার অনেক ভাল পড়ান। স্যারের পড়ানো অনেক ভাল বুঝি আমরা।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরিফা আক্তার বলেন, স্যার অনেক ভাল করে ইংরেজি পড়ায়। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ওে না বুঝলে স্যারের সাথে কথা বলে বুঝে নিতে পারি।
স্থানীয় মোঃ শাহরিয়ার বলেন, একজন অন্ধ বাচ্চাদের এত ভাল বুঝাতে পারে, এটা মামুন ভাইকে না দেখলে বোঝা যাবে না। তবে তার একটি স্থায়ী চাকুরী দরকার। তাহলে হয়ত প্রতিবন্ধী হিসেবে নিজের কষ্টটা ভুলতে পারত।
মামুনের স্ত্রী শেফালী বেগম বলেন, দুই ছেলে, ননদ ও শ্বাশুরিকে নিয়ে একসাথে থাকি আমরা। আমার স্বামীর আয়েই চলতে হয় আমাদের। কোন মতে তিন বেল ভাত জুটলেও, কষ্ট করতে হয় অন্যান্য সবকিছুতে। আমার স্বামীর যদি প্রাইমারি স্কুলে চাকুরী হয়, তাহলে শ্বাশুরির চিকিৎসা ও দুই সন্তানের পড়াশুনাটা অন্তত ভালভাবে করাতে পারব। প্রতিবন্ধী কোঠায় চাকুরীর জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর দয়া ভিক্ষা চান এই নারী।
মোরেলগঞ্জ এসিলাহা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মোঃ হায়দার হোসেন বলেন, অন্ধ হলেও মামুন অনেক মেধাবী। যদি পৃষ্ঠপোষকতা করা যায়, তাহলে ও অনেক বড় শিক্ষক হবে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে ওর যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকুরী হয়।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় মামুনকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। ন্যাশনাল সার্ভিসের অধীনে দুই বছর শিক্ষকতা করেছিল মামুন, ভাল করেছে সেখানে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। নিয়মের মধ্যে থেকে মামুনকে শিক্ষক হিসেবে চাকুরী প্রদান করা হলে সেখানেও মামুন ভাল করবে। মামুনের সাফল্যে অন্য প্রতিবন্ধীরা অনুপ্রানীত হবে বলে দাবি করেন তিনি।