ময়ূরপক্সখী নাওয়ের ছইয়ের ওপর আতর-গোলাপ চুয়া-চন্দন মেখে শুদ্ধ হয়ে সাদা মার্কিন কাপড় গায়ে পড়ে আজ থেকে এক যুগ আগের এই দিনে (২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর) হাওরের সফেদ ঢেউ, নানান রঙের নাও আর শীতল বাতাস ভেদ করে উজানধল গ্রামের দিকে শেষবারের মতো তার নাও ভাসিয়েছিলেন ভাটির পুরুষ কালনী তীরের মহাজন শাহ আবদুল করিম।
বাউল মহাজনদের গলায় যখন ভেসে উঠছিল কেন পিড়িতি বাড়াইলায়রে বন্ধু ছেড়ে যাইবার যদি..., সুরের সাথে থককে দাড়িয়েছিল কালনী নদী আর ভরাম হাওরের স্বচ্ছ জল। সেদিন বিস্তীর্ণ হাওড় ছিল ভাটির মহাজনের শোকে নিস্তব্ধ। আশে পাশের সবার দৃষ্টি ছিল নাওয়ের ছইয়ের দিকে। ছিল না আফালের কোন গর্জন। আমরণ শিষ্য রণেশ ঠাকুর আর বাউল আবদুর রহমান নাওয়ের ছইয়ের ওপর সাদা মার্কিন কাপড়ে মোড়ানো গুরুর পাশে বসে সুর তুললেন প্রাণনাথ ছাড়িয়া যাইয়োনা বন্ধুরে..."। এই সুর যেন ছড়িয়ে পড়লো চারপাশের নাও ভেদ করে পুরো হাওড়ে। সবার আবেগে কাঁপন ধরলো, সবার চোখ ভিজে উঠলো, গলা ভেঙে এল কারণ প্রাণনাথ যে আজ সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। আজ সময় ঘুরে আবার ক্যালেন্ডারের পাতায় ১২ সেপ্টেম্বর। প্রয়াণ দিবসে তোমার প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা হে বাউল স¤্রাট।
বাংলার লোকায়ত গানের সর্বশেষ অধীশ্বর বলা হয় শাহ আবদুল করিমকে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঝুলিতে জমা হয়েছে কেবল আট দিনের অক্ষর জ্ঞান। সিলেট অঞ্চলে অনেক গীতিকবি ও শিল্পীদের জন্মস্থান। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে এক কৃষক পরিবারে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহ আবদুল করিম জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লালন ফকির, হাছন রাজা, রাধারমণ, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ, উকিল মুন্সী, শেখ বানুকে মনেপ্রাণে লালন করে গান বুনেছেন, গান গেয়েছেন। তার রক্ত ও চিন্তাভাবনা জুড়ে ছিল দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ও মাটির গন্ধ। সেসব গান দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গিয়েছে।
তার রচিত দেড় হাজার গানের মধ্যে সংগ্রহে আছে মাত্র ৬শ’। শাহ আবদুল করিম মালজোড়া, বিচ্ছেদ, ধামাইল, জারি, সারি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ও গণ সঙ্গীতসহ নানা ধারার গান রচনা করেছেন। এর মধ্যে- কেনে পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, প্রাণনাথ ছাড়িয়া যাইওনা মোরে, আগের বাহাদুরি এখন গেল কই, বন্ধে মায়া লাগাইছে, গাড়ি চলে না চলে না, আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, বসন্ত বাতাসে সইগো, মাটির পিঞ্জিরার সোনা ময়না রে, কোন মেস্তরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়, আইলা না আইলা নারে বন্ধু, মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ হওয়া যায়, সখি কুঞ্জ সাজাওগো, তুমি বিনে আকুল পরাণ, আমি তোমার কলের গাড়ি, তুমি হও ড্রাইভার, আমি কুলহারা কলঙ্কিনী, কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া, রঙের দুনিয়া তোরে চাই না ইত্যাদি গান দেশে-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
শাহ আবদুল করিম কৃষক পরিবারের অভাব অনটনের মাঝে বেড়ে উঠলেও সঙ্গীতের মায়া তিনি ত্যাগ করতে পারেননি। দিনে রাখালের কাজ করে রাতে পড়াশুনা শিখতে নৈশ-বিদ্যালয়ে যেতেন। অক্ষরজ্ঞানের পর তার মন আর লেখাপড়ায় বসে না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন। এ সময় তিনি গুরুদের সঙ্গে বর্ষা মৌসুমে হাওড় অঞ্চলে গান গেয়ে বেড়াতেন। একদিন ওস্তাদের কথা রাখতে গিয়ে বিয়ে করেন আফতাবুন্নেছাকে। আবদুল করিম স্ত্রীকে ডাকতেন ‘সরলা’ নামে। ১৯৯৭ সালে মারা যান সরলা। জনশ্রুতি আছে, গানের অনুষ্ঠানে থাকায় সরলার মৃত্যুকালে আবদুল করিম পাশে থাকতে পারেননি। পরে খবর পেয়ে বাড়িতে যান এবং ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাওগো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’ ‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচিনা তারে ছাড়া’ এই গানগুলো রচনা করেন। সরলার কবর শোবার ঘরের সামনে দিয়েছেন। ইচ্ছানুযায়ী শাহ আবদুল করিমকে সরলার কবরের পাশে দেয়া হয়।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৭টিÑ আফতাব সঙ্গীত (১৯৪৮), গণ সঙ্গীত (১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮), কালনীর কূলে (২০০১) ও শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯)। তার মৃত্যুর পর প্রকাশ হয় সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত ‘শাহ আবদুল করিম স্মারকগ্রন্থ’। শাহ আবদুল করিমের ১০টি গান ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে বাংলা একাডেমি। তাকে নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র ‘ভাটির পুরুষ’ নির্মাণ করেছেন শাকুর মজিদ। শাকুর মজিদের লেখা নাটক ‘মহাজনের নাও’র ৯২টি প্রদর্শনী করেছে সুবচন নাট্য সংসদ। তার জীবন ও কর্ম নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হয়েছে 'রঙের দুনিয়া'। এ ছাড়া তাকে নিয়ে বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে।
উনিশ শতকের বড় বড় আন্দোলনে সক্রিয় চরিত্র হিসেবে দেখা গেছে তাকে। এর মধ্যে আছে ৫৪ এর নির্বাচন, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন ও ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। তার গণসঙ্গীতে জেগেছিল জনতা। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনে গানে গানে যোগ দিয়েছেন তিনি। ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়পাত্র। পেয়েছেন রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), একুশে পদক (২০০১), লেবাক অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা (২০০৪), চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা (২০০৫), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা (২০০৮), খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮), এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯) ও হাতিল অ্যাওয়ার্ড (২০০৯)।