জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতির চিঠি হাতে পাওয়ার তিনদিন পর বৃহস্পতিবার সকালে মুখ খুলেছেন বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ।
বলেন, আপার কাছে (শেখ হাসিনা) আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হয়েছে। তার অভিযোগের তীর আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের প্রতি। পঙ্কজ দেবনাথ ও শাম্মী আহমেদ একই নির্বাচনী এলাকার মানুষ। শাম্মী আহমেদ বলেছেন, পঙ্কজ দেবনাথের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাম্মীর বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগের ডাকসাইটের নেতা। তিনি ১৯৯১ সালে ওই আসন থেকে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরের অংশগ্রহণমূলক দুটি নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা। পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ওই আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। আসন পুনরুদ্ধারের নায়ক ছিলেন পঙ্কজ দেবনাথ। ২০১৮ সালে তিনি আবার মনোনয়ন পান। তবে ওইসময় একই আসন থেকে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন শাম্মী আহমেদ।
দল থেকে অব্যাহতির বিষয়ে সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, আমার বিরুদ্ধে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে যা ইচ্ছে নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) বলে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী (শাম্মী আহমেদ) আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা, মিথ্যা কথা আপাকে (শেখ হাসিনা) বলেছে। আমার অভিভাবক, আমার নেত্রী এসব বিষয় স্নেহের চোখেই দেখবেন।
এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে শাম্মী আহমেদ বলেন, আমাকে কন পঙ্কজ দেবনাথের অব্যাহতির বিষয়টিতে জড়ানো হচ্ছে? আমার এত ক্ষমতা হয়নি যে প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যা কথা বলবো। তিনি আরও বলেন, আমার বাবা বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। যে কারণে ওই এলাকায় আমি তিনবার গিয়েছিলাম। এ ছাড়া পঙ্কজ দেবনাথের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। তাকে অব্যাহতি দেয়াটা দলের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্ত।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করে সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, আগামী ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। ইউনিয়নের ভোটাররা বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করা ব্যক্তিদের ভোট দেবেনা। তাই কৌশলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের যারা বিজ্ঞ লোকজন রয়েছে, তারাই আমাকে আওয়ামী লীগ থেকে সরাতে কেন্দ্রে সুপারিশ করেছে। তারা কীসের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিল তা বুঝতে পারছিনা। তবে এ ক্ষেত্রে জেলা আওয়ামী লীগের কোন নেতার প্রতি অভিযোগ সেটি স্পষ্ট করেননি সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথের সাথে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের টানাপোড়ন চলে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ওই বিরোধকে কেন্দ্র করে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায়ও আওয়ামী লীগ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পরেছে। দুই পক্ষের বিরোধকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
সূত্রমতে, গত সোমবার সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। একজন সংসদ সদস্যর দলীয় পদ হুট করে কেড়ে নেয়ার ঘটনা সচরাচর ঘটেনা। তাই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ ঘটনার তিনদিন পর বৃহস্পতিবার সকালে দলের কমিটিতে নিজের লোক বসানোর অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেন তিনি (সাংসদ) বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর যে ব্যক্তি উল্লাস করেছিল, তাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। আর জাতীয় পার্টিতে থাকাকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করে আসা ব্যক্তিকে সভাপতি করা হয়েছে। সেই রাজ্যে আমি পঙ্কজ দেবনাথ কেমনে থাকবো?
হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় পঙ্কজ দেবনাথের আধিপত্য থাকায় এতোদিন কোণঠাসা ছিলো জেলা আওয়ামী লীগের অনুসারীরা। তবে এ ব্যাপারে সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, সেখানে কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা আমার নেই। আওয়ামী লীগ বিরোধী লোকজন নিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এমপি হওয়ার আগে আমি উপজেলা কমিটির সদস্য ছিলাম। এমপি হওয়ার পর আমাকে উপদেষ্টা করে একরকম কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। সাংসদ আরও বলেন, বিগত পাঁচ বছরে উপদেষ্টা কমিটির কোনো মিটিং হয়নি। এখানে সাংগঠনিক ক্ষমতা আমার হাতে নেই, তাই গ্রুপিংয়েরও কোন সুযোগ নেই।
স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়ার অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একত্র হয়ে কট্টর বিএনপি করা লোক যারা সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে তাদের মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেছে। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের যেসব নিবেদিত কর্মীরা নির্বাচন করেছে তারা বিজয়ী হয়েছেন। যা তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজ নিলেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।
সাংসদ আরও বলেন, আমি খুনোখুনির রাজনীতি কখনই প্রশ্রয় দেইনি। বরং আমার এসব বিষয়ে শক্ত অবস্থান থাকায় অশুভ শক্তি কৌশলে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করেছে। সম্প্রতি মেহেন্দীগঞ্জ থানার পরিদর্শকের সাথে ফোনালাপের অডিও রেকডিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ফোনালাপে সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র কামাল উদ্দিন খানকে কোপানোর কথা বলেন। এনিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের অনুসারীরা সাংসদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। ওইসময় জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাহাব আহম্মেদ সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথসহ দেশে থাকা হিন্দুদের নিকৃষ্ট বলে অভিহিত করেছেন বলে জানিয়ে সাংসদ বলেন, মেহেদী নামের একজনকে মারধর করেছে মাদকাসক্ত রাতুল। পরে এলাকার লোকজন রাতুলকে মারধর করেছে। সেখানে আমার নাম জড়িয়ে মিথ্যা অপপ্রচার করা হয়েছে। তখন একজনকে ফোন করে বলেছি, বাড়াবাড়ি না করতে। তখন রাগের মাথায় বলেছি।
সবশেষে সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, আমি জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় নেতার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার বদনাম করতে ওইসব নেতারা দীর্ঘদিন থেকে ষড়যন্ত্র করে আসছেন। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ আরো বলেন, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতি করি। কিন্তু দলের তৃণমূল পর্যায়ে কতিপয় প্রভাবশালী নেতার লোক হয়ে রাজনীতি না করার কারণে আমার মতো অনেকের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে দলের মধ্যে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। আমি শতভাগ বিশ্বাস করছি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সব বিষয়ের ফয়সালা হবে। তিনি (শেখ হাসিনা) যে নির্দেশ দিবেন আমি তা মাথা পেতে গ্রহন করবো।