কয়েক বছর ধরে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নিষেধাজ্ঞা, জ¦ালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি আর করোনার কবলে পড়ে সর্বশান্ত ছেলেরা নানা শঙ্কায় গভীর সমুদ্রযাত্রা করছে। অনেকে ঋণের চাপ ও লোকসানে পড়ে দেউলিয়া হয়েছেন। তা স্বত্ত্বেও আগামী ১লা নভেম্বর থেকে দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুম শুরু হওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝুঁকি ও ঋণের বোঝা নিয়ে মৎস্য আহরণে সমুদ্রে যাত্রা করছে জেলারা। জেলেরা সমুদ্রের মৎস্য আহরণ করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলেছে উপকূলীয় জেলে-মহাজনেরা। সাগরে যেতে যে যার মত প্রস্তুত করছেন জাল, দড়ি, নৌকা-ট্রলার। কেউ কেউ গড়ছেন নতুন ট্রলার, আবার কেউ পুরাতন নৌকা মেরামত করে নিয়েছেন। অনেকেই প্রস্তুতির আগেভাগে রওনা দিচ্ছেন। খুলনার মধ্যে পাইকগাছা উপজেলা থেকে সব সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জেলেরা দুবলার চরে মাছ আহরণ করতে যান। মৌসুমের শুরুতে দাদনদারদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে জেলারা তৈরী করেন মাছ ধরার বহর। এ বছর উপজেলার বোয়ালিয়া, হিতামপুর, মাহমুদকাটী, নোয়াকাটি, কপিলমুনি, কাটিপাড়া, রাড়-লী, বাঁকা, দেবদুয়ার, সাহাপাড়া সহ বিভিন্ন গ্রামের জেলে পল্লী থেকে অন্তত আড়াই’শ ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য যাত্রা করেছে। দুবলারচর বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণ, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ যা চর নামে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলা এবং হরিণ বিচরনের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর। এই চরের মোট আয়তন প্রায় ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া এবং মেহেরআলির চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত। দুবলার চরে তৈরি হয় জেলেপল্লী। মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শোকানোর কাজ। বর্ষা মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে চার মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। মেহেরআলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় জেলেপল্লী স্থাপিত হয়। এই চার মাস তারা মাছ শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে শুঁটকি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারী বাজারে মজুদ ও বিক্রয় করা হয়। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগ থেকে মাছ সংগ্রহের অনুমতি সাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করে থাকেন। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ¦ালানি কাঠ) ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য ব্যবসায়ীগণ সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান। এ ছাড়া আহৃত শুঁটকি মাছ পরিমাপ করে নিয়ে ফিরে আসার সময় মাছভেদে প্রদান করেন নির্ধারিত রাজস্ব। খুলনা জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে পলি জমে ভরাট হওয়ায় শুধুমাত্র সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেনি জেলে পরিবারগুলো। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান অবনতির মুখে ইতোমধ্যে পূঁজি ও জাল-নৌকা হারিয়ে পেশা হারিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে চড়াহারে মহাজনদের সুদের মাশুল গুণে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তফশীলি ব্যাংক থেকে জেলেদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করার কথা থাকলেও বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়ায় তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। বোয়ালিয়া জেলেপল্লীর বাসিন্দা শীতেনাথ এফএনএসকে বলেন, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা তেমন কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই না। সুন্দরবনে জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায়সহ অসাধু বনকারবারীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা বন্ধ হলেও নানা শঙ্কায় সমুদ্রে মৎস্য আহরণে যাচ্ছে জেলেরা। ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন জেলে এফএনএসকে বলেন, আমরা প্রতিবছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব সরকারকে দেই। কিন্তু আমরা সহজ শর্তে কোনো ঋণ পাই না। জেলেদের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি আকর্ষণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তারা জোর দাবি জানান।