ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে মন্দায় পড়তে যাচ্ছে জার্মানি ও ইটালি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানি।একটি দেশের অর্থনীতিতে পরপর দুই প্রান্তিকে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিলে সেটিকে মন্দা পরিস্থিতি বলে ধরে নেয়া হয়। সেই হিসাবে আগামী বছর জার্মানি যে মন্দায় পড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। দেশটির অর্থনীতিবিদেরা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রীও সেই পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন। তবে জার্মানির রাজনৈতিক অঙ্গন, কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে এই খবর বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে তেমনটা নয়। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই জার্মানি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে জার্মানিতে বিভিন্ন পণ্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যেই ভোজ্যতেল একসময় দুই ইউরোরও কমে মিলতো তা পাঁচ ইউরোতে পৌঁছায়। এখন দাম কমে তিন-চার ইউরোতে নেমেছে। একইভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দামে ফেব্রুয়ারি পরবর্তী যে ধাক্কা লেগেছিল তার লাগাম কিছুটা টানা গেছে। কিন্তু বড় সমস্যা রয়ে গেছে জ্বালানিতে। রাশিয়ার সরবরাহ বন্ধ থাকায় তেল ও গ্যাসের দাম আকাশচুম্বী। শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখার মতো গ্যাসের মজুত সরকার নিশ্চিত করলেও এর মূল্য মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে।সেই সঙ্গে বিদ্যুতের বিলও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। তাতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। পরিসংখ্যানেও রয়েছে তার প্রতিফলন। ১৯৫১ সালের পর গত মাসে প্রথমবারের মতো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের (১০.৯%) রেকর্ড গড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় রাখতে মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা তিন মাস নয় ইউরো বা প্রায় ৯০০ টাকার টিকেটে গণপরিবহণে গোটা জার্মানি ভ্রমনের সুযোগ দেয় সরকার। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের জন্যই এমন টিকেটের মূল্য প্রায় ১০০ ইউরো বা তারও বেশি থাকে। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে জ্বালানির উপর কর ছাড় দেয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বরে চাকরিজীবীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এককালীন ৩০০ ইউরো বা প্রায় ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে সরকার। মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে না পেরে সেপ্টেম্বরের শেষে ২০ হাজারো কোটি ইউরোর নতুন জ্বালানি ভর্তুকির পরিকল্পনা ঘোষণা করেন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস ও তার অর্থমন্ত্রী। বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের মূল্য নাগালে রাখা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র, মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দিতে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই বাড়তি ব্যয় করবে সরকার। পাশাপাশি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে হিমশিম খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য করছাড়সহ আরো নানা সুবিধাও থাকছে। জার্মানির অর্থনীতির বড় দুই শক্তির একটি তার উচ্চদক্ষ বিশেষায়িত শিল্প, যা দেশটির রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। দ্বিতীয়ত, দেশটির অনন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত, জার্মান ভাষায় যাকে বলে ‘মিট্টেলস্টান্ড’।দেশটির ৯৯ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই এর আওতায় পড়ে, যা জার্মানির দক্ষ কর্মসংস্থানের বড় উৎস এবং জার্মান সমাজের প্রাণশক্তি মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও আঁতুড়ঘর। সরাসরি বাজারে হস্তক্ষেপ না করে যেকোন অর্থনৈতিক সংকটে জনগণের ক্রয়ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে জার্মানি। এজন্য প্রণোদনার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তকে সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি মিট্টেলস্টান্ড খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে মনযোগী হয় সরকার। যাতে সেগুলোর কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মানুষের আয় না কমে। করোনাকালে কিংবা তার আগের বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি এই উপায়ে মোকাবিলা করেছিল জার্মানি। কোম্পানি আর নাগরিকদের অর্থ প্রদান, করছাড়সহ বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এবারও মন্দাকে যতটা সম্ভব স্বল্পমেয়াদী করার কৌশল খুঁজছে সরকার। তবে এই দফায় শিল্পে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখা বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ এই অর্থনীতির মন্দা উত্তরণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে।