ইতিহাসের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক প্রলয়ঙ্করকারী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর দিবস’ আজ (১৫ নভেম্বর) মঙ্গলবার। সিডরের কালো রাতের ভয়াল দূর্যোগ গোটা উপকূলবাসীকে এখনও তাড়া করে ফিরছে। আজও উপকূলের বিভিন্ন জনপদে কান পাতলে শোনা যায় স্বজনহারাদের দীর্ঘশ্বাস।
বিভীষিকাময় দিনটি মনে পরলেই এখনো আঁতকে ওঠেন দক্ষিণাঞ্চলবাসী। উপকূলের মানুষের স্মৃতিতে আজো ভেসে ওঠে শত শত মানুষের চিৎকার আর স্বজনদের বাঁচার আকুতি। সরকারী তথ্যনুসারে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৬টি বড় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হদিস পাওয়া যায়। এরমধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম সিডর। বাংলাদেশে সিডরের আগে যে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত করেছিল, সেগুলোর কোনো নাম ছিল না। এর আগের বড় ঘূর্ণিঝড়গুলোকে ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হতো। এ অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে তার নাম দেওয়া শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে।
সিডর ॥ ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ভরা জোয়ারে ভড় করে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে তিনশ’ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বলেশ্বর নদী মোহনা হয়ে উপকূলের ১০টি জেলার জনপদে হামলে পরে। পর্যাপ্ত প্রাক-সতর্কতার কারণে ইতিহাসের ভয়াবহতম ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানীর সংখ্যা যথেষ্ঠ হ্রাস করা সম্ভব হলেও সম্পদের ক্ষতি ছিল কল্পনাতীত। ঘূর্ণিঝড় সিডরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয় উপকূলের ১০টি জেলায়। যার সিংহভাগই ছিল পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠী ও বরিশালে।
তবে বেসরকারী সূত্রের মতে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আর প্রাণহানী ঘটেছিলো তিন হাজার মানুষের। নিখোঁজ ছিলো আরো সহ¯্রাধীক। পরবর্তীতে নিখোঁজদের আর কোন সন্ধান মেলেনি। ইতিহাসের এক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’র রাতে সাগরপাাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার দুরের বরিশাল পর্যন্ত একইসাথে প্রায় সমান বেগে সিডরের নারকীয় তান্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি বরিশাল মহানগরীতেও ঘূর্ণিঝড় সিডরের তীব্রতা ছিল সোয়া দুইশ’ কিলোমিটার।
১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে পিরোজপুর, ঝালকাঠী ও বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর এবং গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল। একইভাবে ঝড়টি পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার পশ্চিমভাগেও আঘাত হানে। প্রায় পৌনে তিনশ’ কিলোমিটার বেগের ওই ঝড়ের সাথে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপকূলের বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদসহ ফসলি জমিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলো।
সরকারী হিসেব মতে, ১৫ নভেম্বর সিডরের তান্ডবে দক্ষিণ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় চার লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ ও প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তিন হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জন নিখোঁজ হবার কথা বলা হলেও বেসরকারী হিসেবে এসংখ্যাও আরো অনেক বেশী। ধারনা করা হচ্ছে-নিখোঁজ ব্যক্তিদের সিডরে বয়ে আনা জলোচ্ছাস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের সেই ধ্বংসলীলা এখনো গোটা উপকূলবাসীকে তারা করে ফিরছে।
স্মরণকালের কয়েকটি ঘুর্ণিঝড় ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়কে। এরপর সাইক্লোন সিডরের কথা উল্লেখ করা হয়। সিডরের পর তান্ডব চালিয়ে যাওয়া একেরপর এক ঝড়ের নামকরণ হয়-আইলা, মহাসেন, রোয়ানু, মোরা, নার্গিস, ফণী, বুলবুল, সিত্রাং ইত্যাদি। ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের স্মরণকালের কয়েকটি ঘুর্ণিঝড়।
বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড় ॥ প্রাণহানি ও ভয়ঙ্করের দিক থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে ষষ্ঠস্থান দখল করে আছে বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়। ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর বাকেরগঞ্জের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড় ‘দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ ১৮৭৬’ নামেও পরিচিত। ওই ঝড়ে আনুমানিক দুই লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পরবর্তী সময়ে আরও বেশি মানুষ মারা যায় দুর্যোগপরবর্তী মহামারী এবং দুর্ভিক্ষে।
এরআগে ১৯৬০ সালে অক্টোবর মাসে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাতহানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ওই ঝড়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। পরের বছর ১৯৬১ সালের ৯ মে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাতহানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। সে সময় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান। ১৯৬২ সালের ২৬ অক্টোবর ফেনীতে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। ওইসময় প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন।
১৯৬৫ সালের ১২ মে ঘূর্ণিঝড়ে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে প্রাণ হারান ১৯ হাজার ২৭৯ জন। সে বছর ডিসেম্বরে আরেক ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে মৃত্যু হয় ৮৭৩ জনের। পরের বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়। এতে মারা যান ৮৫০ জন।
গ্রেট ভোলা সাইক্লোন ॥ ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’। ওই ঝড়ে চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, ভোলার চর বোরহানুদ্দিনের উত্তরপাশ ও চর তজুমুদ্দিন এবং নোয়াখালীর মাইজদি ও হরিণঘাটার দক্ষিণপাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ।
১৯৮৮ সালের নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা। ওই ঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নেয় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষের জীবন।
ঘূর্ণিঝড় সিডর ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ালতম প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ঘটে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ওইদিন সিডর নামের ঘূর্ণিঝড়ে সরকারীভাবে তিন হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও এক হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানানো হলেও বেসরকারী হিসেবে সিডরে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরা, ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় তিতলি, ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী, একই বছরের ৯ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে সুপার ঘুর্ণিঝড় আম্পান, সবশেষ চলতি বছরের অক্টোবর মাসের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গোটা দেশের সাথে দক্ষিণাঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।
নভেম্বর মানেই আতঙ্ক ॥ ১৭৯৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর শুধু নভেম্বর মাসেই ১১টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি, গৃহপালিত ও বন্য পশুর মৃত্যুর পাশাপাশি সম্পদহানীর ঘটনা ঘটেছে। তাই উপকূলবাসীর মধ্যে নভেম্বর মাস আলাদা একটি আতঙ্কের মাস।