বাংলাদেশের উপজাতি নৃ-গোষ্ঠির গারোদের নিজস্ব সাংস্কৃতি ও কৃষ্টির অন্যতম উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা উৎসব। শেরপুরের ঝিনাইগাতীর মরিয়মনগর সাধু জর্জের ধর্মপল্লীর গির্জা চত্তরে রোববার (২০ নভেম্বর) দিনব্যাপী এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। সকাল নয়টায় থক্কা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সূচনা করেন মরিয়মনগর ধর্মপল্লীর সহকারী পালপুরোহিত ও খামাল ফাদার রর্বাট দিলীপ গোমেজ গোমেজ। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মরিয়মনগর ধর্মপল্লীর পালপুরোহিত ও খামাল ফাদার বিপুল ডেভিট দাস। বক্তব্য দেন মরিয়মনগর প্যারিস কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওনারসন চাম্বুগং, আদিবাসী নেতা আলপন্স চিরান প্রমুখ। উৎসবে ক্রুশচত্বরে বাণী পাঠ, খামালকে খুথুব ও থক্কা প্রদান, জনগণকে থক্কা দেয়া, পবিত্র খ্রীষ্টযাগ, দান সংগ্রহ, আলোচনা সভা ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনার করা হয়। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গারোদের নিজস্ব ভাষায় গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।
গারো সম্প্রদায়ের লোকদের তথ্য মতে, ওয়ানগালা হচ্ছে গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ফসল তোলার উৎসব যা তারা প্রতিবছর পালন করেন। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ অর্থ উৎসর্গ করা। দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও মনোবাসনার নানা নিবেদন হয় এ উৎসবে। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে নতুন খাদ্যশস্য খাওয়া নিষেধ থাকে এ সম্প্রদায়ের জন্য। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকেন। এ ছাড়া এটি ১০০ ঢোলের উৎসব নামেও পরিচিত। সবাই রঙ বেরঙ পোশাক ও পাখির পালক মাথায় দিয়ে লম্বা ডিম্বাকৃতির ঢোলের তালে তালে নাচে। এদিন হলো তাদের বিনোদনের দিন। পুরুষ ও নারীরা দুটি আলাদা সারি গঠন করে এবং নাঁেচর তালে তালে এগিয়ে যান। সাথে থাকে মহিষের শিঙে বানানো এক ধরনের আদিম বাঁশির সুর।
মরিয়মনগর ধর্মপল্লীর পালপুরোহিত ও খামাল ফাদার বিপুল ডেভিড দাস জানান, একসময় গারো পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ হতো এবং বছরে মাত্র একটি ফসল হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’ কে উৎসর্গ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। কারণ হিসেবে জানাগেছে, গারোদের ওই শস্য দেবতা একসময় পাহাড়ি এলাকার গারোদের হাতে কিছু শস্য দিয়ে বলেছিল, ‘তোমরা এটা রোপন কর তাতে তোমাদের আহারের সংস্থান হবে এবং তোমরা যে শস্য পাবে তা থেকে সামান্য কিছু শস্য আমার নামে উৎসর্গ করবে।’এরপর থেকেই গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে। খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গারোরা তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক এই প্রথাটিকে এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে পালন করে থাকেন। অর্থাৎ একসময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিষ্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন। এ সময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয়।
মরিয়ম নগরের ওয়ানগালা উৎসবটি এবার ৩৭ বছরে পা দিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এখানে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হচ্ছে। এবার গারোদের মাঝে উৎসবের আমেজটা অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশী। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য খ্রিষ্টভক্ত এবং গারাগানজিং, কতচু, রুগা, মমিন, বাবিল, দোয়াল, মাতচি, মিগাম, চিবক, আচদং, মাতাবেং ও আরেং নামে ১২ টি গোত্রের গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবার ওয়ানগালা উৎসবে উপস্থিত হয়েছেন। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিয়মনগর সাধু জর্জ ধর্মপল্লীর নিয়ন্ত্রনে জেলার সদর উপজেলাসহ শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী এবং জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার গারো সমাজের ৪৭ টি গ্রাম রয়েছে। ওইসব গ্রমের প্রায় ২২ হাজার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বি গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস।
এদিকে ওয়ানগালা উৎসব উপলক্ষে ধর্মপল্লীর পাশে জমজমাট মেলা বসেছিল। মেলায় গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকসহ শিশুদের নানা রকমের খেলনা বিক্রি করা হয়। ফলে এখানে গারো শিশু ও যুবক-যুবতিরা বিভিন্ন পসড়ার দোকানে তাদের পছন্দের জিনিস কিনতে ভিড় জমান। ওয়ানগালা উৎসবে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবং তাদের আত্মীয়রা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা সাক্ষাত হওয়ায় তারা অনেকটা বড় দিনের উৎসবের মতো আনন্দ উপভোগ করেন।