১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলেও বরিশালের গৌরনদী পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিলো ২২ ডিসেম্বর। জেলার মধ্যে সর্বশেষ বিজয় পতাকা উড়েছিলো গৌরনদী। টানা ২৮দিন মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যৌথ আক্রমণের পর ওইদিন গৌরনদী কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থানরত শতাধিক পাক সেনা মিত্র বাহিনীর মাধ্যমে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলো।
হানাদার বাহিনী অত্র এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা ও তিন শতাধিক মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছিলো। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল পাক সেনারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা গৌরনদীর সাউদের খালপাড় নামকস্থানে তাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। পাক সেনারা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে। সেইদিনের সম্মুখ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন নাঠৈ গ্রামের সৈয়দ হাসেম আলী, চাঁদশীর পরিমল মন্ডল, গৈলার আলাউদ্দিন ওরফে আলা বক্স ও বাটাজোরের মোক্তার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওইদিন আটজন পাক সেনা নিহত হয়। এটাই ছিল বরিশালে স্থলপথে প্রথম যুদ্ধ এবং এরাই হচ্ছেন প্রথম শহীদ। বরিশালের প্রবেশদ্বার মুখে পাক সেনারা গৌরনদীর খাঞ্জাপুরে মোস্তান নামের এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করেছিল।
সেইদিনের প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হবার পর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। পাক সেনাদের গুলিতে ওইদিন দুই শতাধিক লোক মারা যায়। পাক সেনারা গৌরনদী বন্দরসহ শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিল আড়াই শতাধিক সৈন্য ও ৫০ জনের মতো স্থানীয় রাজাকার, আলবদর।
বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রীজে পাক সেনাদের বাঙ্কার ছিলো। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। তাদের দোসর ছিলো এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিচ কমিটির সদস্যরা। হত্যাকান্ড, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণসহ নানা কাজে তারা পাক সেনাদের সহযোগিতা করতো।
সেইদিনের সম্মুখযোদ্ধারা জানান, পাক সেনারা গৌরনদী কলেজের উত্তর পার্শ্বে একটি কূপ তৈরি করে সেখানে লাশ ফেলতো। কলেজের উত্তর পাশের হাতেম পিয়নের বাড়ির খালপাড়ের ঘাটলায় মানুষ জবাই করে খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। গালর্স হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী পুল ও গয়নাঘাটা ব্রীজের ওপর বসে মানুষ হত্যা করে খালে লাশ ফেলতো পাক সেনারা। পাক সেনারা শত শত লোক ধরে এনে ওইসবস্থানে বসে হত্যা করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, গৌরনদীর কসবা এলাকার আল্লাহর মসজিদের কাছে ২৭ নভেম্বর পাক সেনাদের সাথে বন্দুক যুদ্ধে মো. ছাত্তার কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পরেরদিন একইস্থানে দক্ষিণ চাঁদশীর আলতাফ হোসেন শহীদ হন। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া এলাকার কৃষক শ্রমিক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত (সাবেক মন্ত্রী), আবদুল করিম সরদার (সাবেক এমএলএ) সর্বপ্রথম স্বেচ্ছাসেবক দল গঠণ করেন। ওইদলের প্রধান ছিলেন গৈলার মতি তালুকদার, তার সহযোগি ছিলেন পতিহারের নুরু গোমস্তা।
কোটালীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। তিনি সর্বপ্রথম অত্র অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে গৌরনদীর হোসনাবাদ গ্রামের নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে ৬০/৭০ জন মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় আসেন। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
সর্বশেষে মুজিব বাহিনীর একটি দল ভারত থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বর্তমান বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তার (হাসানাত) চাচাতো ভাই রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্বগ্রামের মেজর শাহ আলম তালুকদার ছিলেন তার সহযোগী।
গৌরনদী কলেজে নিজাম বাহিনী ও মুজিব বাহনীর যৌথ প্রচেষ্টায় আক্রমণ চালানো হয়েছিল। পশ্চিম দিক থেকে মুজিব বাহিনী ও পূর্বদিক থেকে নিজাম বাহিনী আক্রমণ করে। টানা ২৮দিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা পরাস্থ হয়ে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বরিশাল জেলার সর্বশেষ হানাদার মুক্ত গৌরনদীতে ১৯৭৫ সালের ৭ মে তৎকালীন মন্ত্রী (বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা) আবদুর রব সেরনিয়াবাত “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ”র ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ বছর পেরিয়ে গেলেও গৌরনদীতে আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি সৌধ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষনে দ্রুত স্মৃতি সৌধ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।