যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন নির্বিঘœ ও নিরাপদ করতে বরিশাল-চট্টগ্রাম নৌরুটে শতাধিক কোটি টাকায় তিনটি নৌযান সংগ্রহ ও দুইটির পুনর্বাসন করেছে সরকার। এরপরেও উপকূলীয় দুটি বিভাগীয় সদরের মধ্যে নিরাপদ নৌ যোগাযোগ সচল করার উদ্যোগ নেই বিআইডব্লিউটিসি’র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই দশক ধরে বরিশাল-চট্টগ্রাম নৌরুটের কথা বলে নৌযান সংগ্রহ ও পুনর্বাসনে সরকারের কাছ থেকে কয়েক দফায় বিপুল অর্থ গ্রহণ করেও রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি এ রুটে নিরাপদ নৌযোগাযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে বরিশাল থেকে ভোলা-হাতিয়া-সন্দ্বীপ হয়ে চট্টগ্রামের নিরাপদ নৌ যোগাযোগের ভবিষ্যত এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পরেছে।
সূত্রমতে, অতিসম্প্রতি ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল রুটে রকেট স্টিমার সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছতে ২৪ ঘন্টারও বেশী সময় লাগছে। এমনকি দক্ষিণাঞ্চল থেকে নৌপথে চাঁদপুর হয়ে রেলপথে চট্টগ্রাম পৌঁছার বিকল্প পথটিও বন্ধ হয়ে গেছে। যেকারণে চরম দুর্ভোগে পরেচেন দক্ষিণাঞ্চল থেকে চট্টগ্রামগামী সাধারণ যাত্রীরা।
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ প্রায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল-ভোলা-হাতিয়া-সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটের জন্য ‘এমভি তাজউদ্দিন আহমদ’ ও ‘এমভি আইভি রহমান’ নামের দুটি উপকূলীয় যাত্রিবাহী নৌযান সংগ্রহের পর গত বছরের ২ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলক পরিচালন সম্পন্ন হয়। তবে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার কথা বলে একবছরেও এর বাণিজ্যিক পরিচালন শুরু করতে পারেনি রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। তবে নৌযান দুটি বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটের পরিবর্তে চট্টগ্রাম-হাতিয়া এবং কুমিরা-গুপ্তছড়া রুটে চলাচল করছে।
সূত্রের দাবি, বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটের কথা বলে চীনা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে ২০০২ সালে প্রায় ৩৩ কোটি টাকায় ‘এমভি বার আউলিয়া’ নামের একটি নতুন নৌযান সংগ্রহের পাশাপাশি ২০০৯ সালে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘এমভি আবদুল মতিন ও এমভি মনিরুল হক’ নামের দুটি উপকূলীয় নৌযান পুনর্বাসন করা হয়। এরমধ্যে এমভি বার আউলিয়া সংগ্রহের পর গত ২০ বছরে তার পুনর্বাসন ও নতুন ইঞ্জিন সংযোজনে আরো প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব কিছুর বাহিরেও বিশ^ ব্যাংকের সুপারিশে দেশের উপকূলভাগে নিরাপদ যাত্রী পরিবহনকে সরকার ‘গণ দায়বদ্ধ সেবাখাত’ হিসেবে ঘোষণা করে প্রতিবছর বিআইডব্লিউটিসি’কে নগদ ভর্তুকি প্রদান করে আসছে। এত কিছুর পরেও ২০১১ সালের মে মাস থেকে দেশের উপকূলীয় দুটি বিভাগীয় সদরের মধ্যে নিরাপদ নৌ-যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি’র পরিচালক (বাণিজ্য) আশিকুজ্জামান বলেন, ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর বরিশাল-চট্টগ্রাম নৌপথে ‘এমভি তাজউদ্দিন আহমদ’কে নিয়ে পরীক্ষামূলক পরিচালনের পরে নৌপথের ‘বামনীর নালা’ ও ‘সেলিম বাজার টেক’ এলাকায় নাব্যতা উন্নয়নের অনুরোধ জানানো হয়। তিনি আরও বলেন, ওইসব এলাকায় নাব্যতা সংকট থাকায় উপকূলীয় নৌযানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রম করতে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। একারণে যাত্রীবাহী নৌযানগুলোকে বরিশাল বা চট্টগ্রামে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় নদীতে নোঙরে থাকতে হবে। একারনেই উপকূলীয় যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস চালু করা সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ওই এলাকায় ড্রেজিং সম্পন্ন করে পুরো নৌপথটিকে ন্যূনতম ১৫ ফুট গভীরতার নৌযান চলাচলের উপযোগী করার সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান শিপিং করপোরেশন পশ্চিম জার্মানী থেকে সংগ্রহ করা চারটি উপকূলীয় যাত্রীবাহী নৌযানের সাহায্যে চট্টগ্রাম-নারায়নগঞ্জ-বরিশাল-চট্টগ্রাম ও বরিশাল-হাতিয়া-সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে উপকূলীয় স্টিমার সার্ভিস চালু করে। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব খানের কন্যাদের নামে ‘এমভি জাকিয়া, এমভি জরিনা, এমবি জোহরা ও এমভি জোবেদা’ নৌযানের নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের পর ওইসব স্টিমারগুলো শহীদদের নামে নামকরণ করা হয়। ‘এমভি আবদুল মতিন, এমভি মনিরুল হক, এমভি আলাউদ্দিন আহমদ ও এমভি তাজুল ইসলাম’ নামের নৌযানগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্বাসন করা হয়। ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে নৌযান দুটি খুব বেশিদিন নির্বিঘেœ চলাচল করেনি। ফলে ২০১১ সালের মাধ্যভাগ থেকে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলীয় স্টিমার সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যায়।
অপরদিকে ২০০২ সালে সংগ্রহ করা ‘এমভি বার আউলিয়া’ নৌযানটিতেও সংগ্রহের কয়েক বছরের মধ্যে কারিগরি ও যান্ত্রিক ত্রুটি শুরু হয়। ইতোমধ্যে দুই দফায় ভারী মেরামত ও পুনর্বাসন শেষে গত বছর মূল ইঞ্জিন পরিবর্তনের পরে যাত্রী পরিবহনে ফিরলেও বরিশালের পরিবর্তে অন্য রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করে।