ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সড়কপথে যোগাযোগের একমাত্র প্রবেশপথ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার বিভিন্নঅংশের সড়কে অসংখ্য টিউমার দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া মহাসড়কের একাধিকস্থানে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত থাকায় ব্যস্ততম এ মহাসড়কটি এখন মরনফাঁদে পরিনত হয়েছে।
প্রতিদিনই ছোট-বড় অসংখ্য দূর্ঘটনার পাশাপাশি এ সড়কে যানজট লেগেই রয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে নামেমাত্র মহাসড়কের খানাখন্দ মেরামতের কাজ চলমান থাকলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। ভূক্তভোগীরা দ্রুত সড়কের খানাখন্দের সংস্কারসহ টিউমার অপসারনের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। পাশাপাশি মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে প্রাথমিকভাবে বরিশাল বিভাগীয় শহর পর্যন্ত ফোরলেন সড়কে উন্নীত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
রোববার সকালে সরেজমিনে গৌরনদীর ভুরঘাটা থেকে বাটাজোর পর্যন্ত মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের বিভিন্ন অংশে পিচ ও পাথরে একাকার হয়ে সড়কের দুইপাশে উঁচু হয়ে জেগে উঠেছে টিউমার। একদিকে ছোট-বড় খানাখন্দ, অপরদিকে সড়কের পাশে জেগে ওঠা টিউমারে দিশেহারা হয়ে পরছেন ছোট-বড় যানবাহনের চালকরা। এমনকি অনেকস্থানেই সড়ক ভেঙে মহাসড়কের পূর্ব সীমানার বাহিরে চলে গেছে।
মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াতকারী মোটরসাইকেল চালক মনির হোসেন, মেহেদী হাসান, জসিম হাসানসহ একাধিক চালকরা বলেন, দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধণের পর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা পূর্বের চেয়ে প্রায় চারগুন বৃদ্ধি পেলেও সড়ক প্রশস্ত হয়নি। পূর্বের সড়কে অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল করায় গত একমাস ধরে মহাসড়কের গৌরনদীর ভূরঘাটা, বার্থী, কটকস্থল, সাউদেরখালপাড়, টরকী, কসবা, গৌরনদী বাসষ্ট্যান্ড, আশোকাঠী, কাসেমাবাদ, মাহিলাড়া, বাটাজোরসহ সড়কের বিভিন্নঅংশে টিউমার আর খানাখন্দে একাকার হয়ে গেছে। ফলে প্রতিনিয়ত যানবাহনগুলো দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
মহাসড়কের পাশে আশোকাঠী এলাকার বসবাসকারী বাসিন্দা মোফাজ্জেল সরদার বলেন, রাতে চলাচলকারী যানবাহনগুলো খানাখন্দে পরলেই বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে হচ্ছে যানবাহনগুলো দূর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। তিনি মহাসড়কের টিউমার অপসারনসহ সড়কটি সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত ব্যস্ততম এ মহাসড়কটি ফোরলেনে উন্নীত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ রুটের একাধিক পরিবহন চালকরা বলেন, খানাখন্দের মধ্যে নামেমাত্র পাথরের খোঁয়া ও পিচের প্রলেপ দিয়ে সংস্কার করা হলেও তা ২/১ দিনের বেশি টিকছে না। পাশাপাশি সড়কের পাশের টিউমারগুলো অপসারন না করায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই তাদের চলাচল করতে হচ্ছে। তারা আরও বলেন, সড়কটি যতোবারই সংস্কার করা হোক না কেন, যে পর্যন্ত ফোরলেন সড়কে উন্নীত না হবে ততোদিন দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দুর্ভোগ লাঘব হবেনা।
বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী অরুন কুমার বলেন, মহাসড়কের খানাখন্দ মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে। অচিরেই উঁচুস্থানগুলো (টিউমার) অপসারণ করা হবে।
সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, মরনফাঁদে পরিনত হওয়ায় মহাসড়টি দ্রুত সংস্কারের পাশাপাশি ব্যস্ততম এ সড়কটি ফোরলেনে উন্নীত করার কোন বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে পুরো মহাসড়কটি ফোরলেনে উন্নীত করা না হলেও ভাঙ্গা থেকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাসষ্ট্যান্ডগুলোতে ফোরলেন সড়কের আওতায় আনা হলেও দুর্ভোগ অনেকটা কম হবে। এতে করে যানজটও কমে আসবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চলতিপথে যানবাহনগুলোতে যানজট হয়না, এটা (যানজট) সাধারণত বাসষ্ট্যান্ডগুলোতে যানবাহনগুলো পাকিং করে রাখার কারণেই যানজটের সৃষ্টি হয়। তাই প্রাথমিকভাবে বাসষ্ট্যান্ডগুলোতে ফোরলেন সড়কের আওতায় আনা হলে দুর্ভোগ কমে আসবে।
ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কটি ফোরলেনে উন্নীত করা হলে পদ্মা সেতুর পুরো সুফল পাবেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী একথা অকপটে স্বীকার করে সদ্যযোগদানকারী বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্য উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই আন্তরিক। তাই আমার শতভাগ বিশ্বাস রয়েছে প্রধানমন্ত্রী খুব শীঘ্রই ফোরলেন সড়কে উন্নীত করার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আর ফোরলেন সড়কের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কোন নির্দেশনা পেলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি আরও বলেন, মহাসড়কের খানাখন্দগুলো দ্রুত সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।
অপ্রশস্ত মহাসড়কে বিবেকহীন প্রতিযোগিতা ॥ বরিশাল-ফরিদপুর ও বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়কটি ইতোমধ্যে মরনফাঁদে পরিনত হয়েছে। গত ২৬ জুন দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হবার পর ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কটির ক্ষমতার তুলনায় যানবাহনের চলাচল কয়েকগুন বেড়েছে। একইসাথে প্রতিদিন লাশের মিছিলও দীর্ঘতর হচ্ছে। এ মহাসড়কে দুর্ঘটনা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। গত ২৭ জুন থেকে এ মহাসড়কে প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনায় একাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে।
সূত্রমতে, অপ্রশস্ত সড়কে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর বিবেকহীন প্রতিযোগিতার কারণে জানমালের ক্ষতি বেড়ে চললেও তা নিয়ন্ত্রনে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ পুলিশ প্রশাসনের তেমন কোন উদ্যোগ নেই। গত জুন মাসের শেষভাগ থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বরিশাল থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় একসাথে এক থেকে ছয়জন পর্যন্ত যাত্রীর প্রাণহানী ঘটেছে। দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনের চালক ও হেলপারের প্রাণহানীর ঘটনাও ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সবশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়কের নগরীর কাশিপুর এলাকায় দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক চালক নিহত হয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত জুনের শেষ থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যস্ততম এ মহাসড়কে অর্ধশতাধিক যাত্রীর প্রাণহানীর পাশাপাশি কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন।
সচেতন নাগরিকদের মতে, পদ্মা সেতু চালু হবার পর বরিশাল থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরের ঢাকায় তিন থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে যাত্রীদের পৌঁছে দেয়ার নিশ্চয়তায় অধিকাংশ যাত্রীবাহী পরিবহন বিবেকহীন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এ মহাসড়কটি মাত্র ১৮ থেকে ২৪ ফুট প্রস্থ। এরমধ্যে অনেকস্থানে মহাসড়কটির অবকাঠামোগত অবস্থা খুবই নড়বড়ে। ১৯৬০-৬৫ সালের মধ্যে মাত্র পাঁচটন ক্ষমতার বহনক্ষম ১২ ফুট প্রস্থ মহাসড়ক নির্মানের পর বিগত ৬০ বছরে দুই পাশে আরো ছয় থেকে ১০ ফুট প্রশস্ত করা হলেও বহন ক্ষমতা আর বাড়েনি। কিন্তু সেই মহাসড়কেই এখন ৩৬ টন বহনক্ষম ভারী যানবাহন চলাচল করছে। ফলে বার বার মেরামত ও পুনর্বাসন করেও মহাসড়কটির স্থায়ীত্ব এক বছরের বেশী টেকানো যাচ্ছেনা।
সূত্রমতে, ২০১৫ সালে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কটি ছয়লেনে উন্নীত করার সরকারি সিদ্ধান্তের পরে ২০১৮ সালে ভূমি অধিগ্রহনে সরকার ১৮শ’ কোটি টাকা ছাড় করে। পাশাপাশি প্রস্তাবিত ছয়লেন মহাসড়কের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। কিন্তু পরামর্শক চূড়ান্ত নকশা জমা দিলেও তাতে বেশ কিছু ক্রুটি ধরা পরায় বিষয়টির আর কোন অগ্রগতি হয়নি। পাশাপাশি ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করার মেয়াদ ২০২০ সালে নির্ধারিত থাকলেও ২০২২ সালের শেষে এসেও তা আলোর মুখ দেখেনি। একইসাথে দাতার অভাবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পটির ভবিষ্যত খুব আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে নেই। ফলে এ মহাসড়কটি ছয়লেনে উন্নীত করণের কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। একইসাথে অপ্রশস্ত ও নড়বড়ে মহাসড়কে সীমাহীন গতির অসম বিবেকহীন প্রতিযোগিতায় দক্ষিণাঞ্চলের অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া থেকে শুরু করে জানমালকে ক্রমাগত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুললেও তা থেকে উত্তরণে কারো মাথা ব্যথা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল সড়ক জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, আমরা ভূমি অধিগ্রহণে অনেক আগেই ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসনকে প্রস্তাবনা দিয়েছি। তবে বিষয়টি খুব কাঙ্খিতগতিতে এতোদিন না এগুলেও অতিসম্প্রতি একাজে গতি এসেছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যেই বেশীরভাগ ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছবে বলেও তারা উল্লেখ করেন।