পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চলতি শীত মৌসুমে সারাদেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় ৬ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস মানে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। তাদের হিসেবে, টানা কয়েকদিন মৃদু শৈত্যপ্রবাহের পর গত সোমবার ও মঙ্গলবার মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েছে। তিনি বলেন,“হিমালয়ের বাতাস সরাসরি তেঁতুলিয়া হয়ে পঞ্চগড়ে প্রবেশ করায় রোদ উঠলেও তীব্রতা ছড়াতে পারছে না। এতে এই এলাকায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। আগামী কয়েকদিন আবহাওয়া একই রকম থাকতে পারে।” সপ্তাহ জুড়ে পঞ্চগড়ে জেঁকে বসা শীত, উত্তরের হিমেল হাওয়ার দাপট আর ঘন কুয়াশা মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি রাতেই বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে। ঘন কুয়াশার দাপট থাকে অনেক বেলা পর্যন্ত। মঙ্গলবার সকাল ৯টার পর সূর্যের দেখা মিললেও হিমেল হাওয়ায় সূর্যের তাপ গায়ে লাগছে না। তীব্র শীতে হাসপাতালে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “আগের তুলনায় শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এজন্য শিশু ওয়ার্ড ২০ বেডের ধারন ক্ষমতার প্রায় ৬০ জন বেশি রোগী রয়েছে, তাদের সঙ্গে আবার অভিভাবকরাও রয়েছেন।” নিরুপায় হয়ে কর্তৃপক্ষ বারান্দায় ও মেঝেতে কিছু রোগী থাকার ব্যবস্থা করেছে। এ সংখ্যাও প্রায় ৩০ জনের মত বলে তিনি জানান। পঞ্চগড় শহরের ইসলামবাগ এলাকার আবেদ হোসেন (৫৮) বলেন, “তাপমাত্রার হিসাব ভাই আমরা অত বুঝিনা। গত কয়েকদিন ধরে বেশি শীত লাগেছে, বাজারে লোকজন কমে গেছে। বেচাকেনা কম হচ্ছে; এজন্য আয় কমে সংসারে টান পড়েছে।” করতোয়া নদী থেকে পাথর ও বালু তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন মীরগড় এলাকার ৫৮ বছরের আফজাল মিয়া। তিনি বলেন, “তীব্র শীতে সকাল সকাল নদীতে নামা যায় না, নামলেও বেশিক্ষণ থাকা যায় না।” তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে কম আয়ের সংসার চালানো বেশ কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দুয়েকটা কম্বল পাইলে উপকার হইত। কিছু টাকাও বাঁচত, গরমে আরামও পাইতাম। জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, পঞ্চগড়ের শীতার্ত মানুষের জন্য এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ৪০ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিভিন্ন এলাকার শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও কম্বল বিতরণের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে বেড়েই চলেছে শীতের তীব্রতা। সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন হতদরিদ্র ও ছিন্নমূলের মানুষেরা; বাড়ছে শীতজনিত রোগ। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ঠাকুরগাঁও জেলায় সূর্যের দেখা মিললেও তাপ নেই বললেই চলে। সকাল ১০টায় থার্মোমিটারের পারদ নেমেছে ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপণ্ডপরিচালক মো. আবদুল আজিজ জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ছিলো ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে গত সোমবার তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রোববার ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শনিবার ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও শুক্রবার ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিলো। তিনি বলেন, “গত বছরের তুলনায় এ বছর শীতের তীব্রতা অনেক বেড়েছে; সপ্তাহখানেক ধরে সূর্যের দেখা মেলেনি। কখনো সূর্যের দেখা মিললেও তাপমাত্রা একদমই নেই। শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। কনকনে শীতের কারণে কৃষকরা মাঠে কাজ করতে পারছে না।” সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঠাকুরগাঁও জেলায় দিনভর কুয়াশাচ্ছন্ন থাকছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছেন না; তাই রাস্তাঘাটও ফাঁকা। কনকনে শীতে ভোগান্তিতে পড়ছেন ছিন্নমূল ও খেটে খাওয়া মানুষেরা। দিনের বেলায় সড়কগুলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে যানবাহন। রাতে-দিনে শীত থেকে বাঁচতে খঁড়কুটো জ্বালিয়ে তাপ পোহাচ্ছেন অনেকে। অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রা থমকে গেছে। কাজকর্মে গতি কমে যাওয়ায় অনেকের রোজগারও কমে গেছে। জেলা শহরের বেলতলা এলাকার রিকশাচালক আমিরুল ইসলাম বলেন, “শীতের আগে ভোর বেলায় রিকশা নিয়ে বের হতাম আয়ের জন্য। আর এখন কনকনে ঠাণ্ডায় রিকশা বের করতেই পারছি না। তারপরও কষ্ট করে বের হলেও যাত্রী পাই না। ফলে আয়-রোজগার অনেক কমে গেছে।” সদরের নারগুন ইউনিয়নের কহরপাড়া গ্রাম থেকে আসা শহরের চৌরাস্তায় কাজের অপেক্ষায় থাকা দিনমজুর নজরুল ইসলাম বলেন, “গতবছর শীতের তীব্রতা কম ছিলো। কিন্তু এ বছর শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। চারদিন ধরে শহরে আসছি কাজের জন্য, কিন্তু কাজ পাঁচ্ছি না। এখন উপায় না পেয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।” শহরের ট্রাক চালক জয়নাল আবেদিন বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে শীতের তীব্রতা এতই বেশি যে দিনের বেলায় হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এ শহরে বৃষ্টির মত করে কুয়াশা পড়ছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় গাড়ি চালানো কষ্টকর হয়ে গেছে। সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের খোচাবাড়ি এলাকরা কৃষক মজিবর রহমান বলেন, “ধারা দেনা করে ২০ কাঠা জমিত এইবার আলু আবাদ করিবা চাহিনু; কিন্তু হামার এততি হাড়কাঁপা ঠাণ্ডা পড়িছে। এইতে আলু লাগাবা পারুনা।” শহরের বসিরপাড়া এলাকার সামসুল হক বলেন, “হিমালয়ের পাদদেশে ঠাকুরগাঁও জেলা হওয়ায় এ অঞ্চলে শীতের তীব্র অনেক বেশি থাকে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ঠাকুরগাঁওয়ে শীত প্রচণ্ড বেশি। হিমেল হাওয়ায় এর তীব্রতা আরও বাড়িয়েছে। কুয়াশা ঝড়ছে বৃষ্টির মত। “কনকনে ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষজন। এতে করে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অনেক কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।” এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে বেড়েছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ফিরোজ জামান জুয়েল বলেন, “হাসপাতালে শীতজনিত শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের চাপ বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৭ জন। বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ জনের মত। “এছাড়াও গত এক সপ্তাহে শীতজনিত রোগে প্রায় এক হাজারের মত শিশু, বৃদ্ধসহ অন্যান্য বয়সী রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছেন।” শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়ার জন্য অভিভাবকদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান এ চিকিৎসক। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “এ জেলায় শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। ঠাকুরগাঁও জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। “কনকনে ঠাণ্ডায় সবচেয়ে কষ্টে আছে শিশু ও বৃদ্ধ মানুষেরা। তাই সকলকে সচেতন থাকতে হবে।” তিনি জানান, সরকারিভাবে ২৮ হাজার কম্বল বরাদ্দ পেয়েছেন তারা। সেগুলো অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে। আরও ৩০ হাজার কম্বল ও ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের জন্য চাহিদাপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।