দেশে গ্যাস নিয়ে সংকট শুরুর পর বছর পেরিয়ে গেলেও উত্তোরণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। চলতি শীতে সমস্যা আরও বেড়েছে। বাসাবাড়ি থেকে শিল্পকারখানা- সর্বত্র গ্যাসের জন্য হাহাকার। ভোরে উঠেও রান্নার জন্য চুলা জ্বালানোর গ্যাস পাঁচ্ছে না রাজধানীবাসী। তবে মাস শেষে ঠিকই গুনতে হচ্ছে বিল। এলপিজি, বৈদ্যুতিক চুলায় চলছে দৈনন্দিন রান্না, অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে যা বাড়িয়েছে মাসের খরচ। নিকট ভবিষ্যতে গ্যাসের সংকট সমাধানের বিষয়ে কোনো সুখবরও দিতে পারছে না সরকার। তবে নির্বাহী আদেশে আরেক দফা বাড়ানো হতে পারে গ্যাসের দাম। অথচ গত জুনেই গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ।
চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই চলছে গ্যাস সংকট। ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে সরকার। এতে সংকট সহনীয় পর্যায়ে আসে। তবে ভোগান্তি বাড়তে থাকে ২০২১ সালের শেষ থেকে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি কমিয়ে দেয় সরকার। ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। লোকসান কমাতে গত জুলাই থেকে খোলাবাজারের এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় থাকা কাতার ও ওমানের দুই কোম্পানিও সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে দিনেই গ্যাসের সরবরাহ ৩০-৩৫ কোটি ঘনফুট কমে গেছে। এতে সব খাতেই গ্যাসের সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। গ্যাস স্বল্পতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় দেশজুড়ে ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়। রেশনিং করেও গ্যাসের ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়নি।
এখন ঢাকার অনেক এলাকার বাসাবাড়িতে চুলাই জ্বলছে না।
বাড্ডার বাসিন্দা রইস উদ্দিন জানান, গত বছর থেকে গ্যাসের স্বল্পতা অনেক বেড়েছে। আগে সকাল ১০-১১টার পর গ্যাসের চাপ কমে গেলেও বিকেলেই ফিরে আসত। গত কয়েক মাস ধরে সকাল ৭টার পর চুলা জ্বালানোর মতো গ্যাস থাকে না লাইনে। রাত ১১টার পর গ্যাস আসে। তবে গত দুই সপ্তাহ ধরে ৬টার আগেই চুলা নিভে যাচ্ছে। এতে সারাদিনই রান্নার কাজ ইলেকট্রিক চুলা, ওভেন আর ইলেকট্রিক কুকারে করতে হচ্ছে। মিরপুরের আবিদ সরকার ও মোহাম্মদপুরে রোজিনা আক্তার জানান, রান্নার জন্য তাঁরা ছয় মাস ধরে এলপিজি ব্যবহার করছেন। এতে মাসে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে প্রতিটি পরিবারে। আবার গ্যাসের মাসিক বিলও দিতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী, টিকাটুলী রামপুরা, মতিঝিল, মালিবাগ, মিরপুর, মগবাজার, ধানমন্ডি, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বাড্ডাসহ রাজধানী এবং এর আশপাশের নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, সাভারসহ অধিকাংশ এলাকায় গ্যাসের ভোগান্তি মাত্রা ছাড়িয়েছে।
ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাসের এক পরিচালক জানান, দিনে তাঁদের ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ১৫০ কোটি ঘনফুট। গ্যাস ঘাটতিতে গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, নারায়ণগঞ্জের শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন প্রায় বন্ধের পথে। কেউ এলপিজি, কেউ সিএনজি দিয়ে কোনো রকমে উৎপাদন ধরে রেখেছেন।
গ্যাসের চাপ কম থাকায় ভুগছে সিএনজিচালিত যানবাহন খাত। স্বল্প চাপের কারণে একটি যানে গ্যাস নিতে আগের চেয়ে তিন-চার গুন বেশি সময় লাগছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান-উৎপাদনে জোর না দিয়ে সরকারের ঝোঁক এলএনজি আমদানির দিকে। কারণ, এতে কমিশন মেলে। এখন বিশ্ববাজারে দাম বেশি বলে এলএনজির আমদানি কমানো হয়েছে। দেশীয় উৎপাদনও তেমন বাড়েনি, যার খেসারত দিচ্ছে জনগণ। আবার গ্যাস দিতে না পারলেও দাম ঠিকই বাড়ানো হচ্ছে। গত জুনে এলএনজি আমদানির যে হিসাব ধরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, সেই পরিমাণ আমদানি হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা এখন সরবরাহ করছে ২৬৬ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে আসছে মাত্র ৪২ কোটি ঘনফুট। মোট গ্যাসের মধ্যে বিদ্যুতে ২৫০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৮২ কোটি ঘনফুট। সার কারখানার চাহিদা ৩২ কোটি ঘনফুট। দেওয়া হচ্ছে ৩১.৬ কোটি ঘনফুট। বাসাবাড়িতে ৬০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে মিলছে ৩০ কোটি ঘনফুট।
গ্যাস সংকটের বিষয়ে গত সোমবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে। তাই সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাসাবাড়িতে পাইপের গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এ সময় তিনি এলপিজির কথা বলেন।