ময়মনসিংহের ভালুকায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে তিনটিসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ১৫ টি লাইসেন্সবিহিন ইটভাটা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই পরিচালিত হয়ে আসছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়ার মতো না হলেও রহস্যজনকভাবে বেশ কয়েটি ভাটার ছাড়পত্র নিয়ে ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দেদাঁড় কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ফলে মারাত্মক হুমকীর মুখে পড়েছে ফসলি জমি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।
ইট প্রস্তুত ও ভাঁটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ (যা ১ জুলাই/২০১৪ থেকে কার্যকর) এ বলা হয়েছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির অর্থাৎ জিগজ্যাগ ক্লিন, হাইব্রিড হফম্যান ক্লিন, বার্টিক্যাল শফট ক্লিন, টানেল ক্লিন বা অনুরুপ উন্নততর কোনো প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে, আবাসিক ও জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকার বনভূমি এবং জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা করা যাবেনা এবং সরকারী বনাঞ্চলের সীমারেখা হতে দুই কিলোমিটার দুরত্বে করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর হতে ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন বা লাইসেন্স না নিয়ে ইটভাটা চালু করা যাবেনা। আর এই আইন অমান্য করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
আর এসব ইটভাটা তদারকি করার জন্য জেলা প্রশাসকের নির্দেশে স্থানীয় বনবিভাগ উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকলেও তাদের রহস্যজনক নিরবতার কারণে ভালুকার অধিকাংশ ইটভাটা মালিক এসব আইনের তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে দেদার তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে আশপাশ এলাকার আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাসসহ বিভিন্ন প্রজাতীয় ফলজ, বনজ গাছপালাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন উপজেলার ধলিয়া পলাশতলী গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, পলাশতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তরপাশ ঘেষে তিনটি ইটভাটা। হুমায়ন কবির খানের লাইসেন্স বিহিন আল সাফা ব্রিক্সসহ তিনটি ইটভাটার চারপাশে মজুদ করে রাখা হয়েছে কয়েক’শ মন লাকড়ি। চিমনী দিয়ে প্রচন্ড বেগে বের হচ্ছে ধোয়া। আর সেই ধোয়া স্কুলের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীসহ আশপাশের বসতি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে ধলিয়া গ্রামে অবস্থিত দুলু চৌধুরীর মির্জা ব্রিক্সেও একই চিত্র চোখে পড়েছে।
এদিকে সরকারী কার্পেটিং রাস্তার ৫০০ মিটারের ভেতর ভাঁটা স্থাপন নিষিদ্ধ হলেও ভালুকা উপজেলার ভায়াবহ গ্রামে ভালুকা সখিপুর সড়ক ঘেষে এবং আবাসিক ও ফসলি জমিতে ফোকাস অটো ব্রিক্স নামে একটি ইটভাটা পরিচালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। পরিবেশের ছাড়পত্রও দেয়া হয়েছে রহস্যজনক ভাবে। তাছাড়া ভালুকা বিরুনীয়া, ভালুকা মেদিলা ও শান্তিগঞ্জ সাইনবোর্ড সড়কের পাশে বেশ লাইসেন্স বিহিন কয়েকটি ইটভাটা চালু রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভালুকা উপজেলার খারুয়ালী, ধলিয়া, মেদীলা, মেদুয়ারী, ভায়াবহ, বিরুনীয়া, রাংচাপড়া, শান্তিগঞ্জ, চান্দরাটি, হবিরবাড়ি, উথুরা ও ভালুকা উপজেলার সীমান্তবর্তী উরাহাটিসহ ভালুকার বিভিন্ন এলাকায় ১৫ টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার দু’্একটি ছাড়া কোনটিরই হালনাগাদ লাইসেন্স নবায়ন নেই। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ইটভাটায় শিশু ও নারী শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়ে থাকে এমনকি ইট তৈরীতে ৬ থেকে ৭ ধরণের ডাইস ব্যবহার করা হয় এবং ইটের সাইজ ছোট-বড় করে প্রতিনিয়তই ক্রেতাদের সাথে প্রতারণা করা হয়ে থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ইটভাটা মালিক জানান, ভালুকার দু’একটি ছাড়া কোন ভাটারই লাইসেন্স নেই। কিভাবে চলে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, জেলা প্রশাসক ও বনবিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টর ম্যানেজ করেই ভাঁটা পরিচালনা করা হয়ে থাকে। আর এসব ম্যানেজ করে থাকেন উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির নেতারা।
আল সাফা ব্রিক্সের মালিক হুমায়ূন কবির খান জানান, ভালুকায় ১৫ টি ইটভাটা রয়েছে। দু’একটি ছাড়া কোনটারই লাইসেন্স নেই। প্রতিটি ইটভাটা থেকে ভাঁটা মালিক সমিতির সভাপতি ও সেক্রেটারীকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দেয়া হয় সার্বিকদিক দেখবাল করার জন্য। উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন জানান, ভালুকায় ১৫ টি ইটভাটা রয়েছে। তার মাঝে চারটির লাইসেন্স থাকলেও দু’টির নবায়ন আছে। সার্বিকদিক ম্যানেজ করেই বরাবর যেভাবে চালানো হয়ে থাকে, এ বছরও সেভাবেই ভাটাগুলো পারিচালিত হচ্ছে। সরকার ভাটাগুলো ভেঙে দিলে তাদের কিছুই করনীয় নেই। এ ব্যাপারে ভালুকা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) কমিটির সদস্য মোহাম্মদ রইচ উদ্দিন জানান, আমার অফিসে ইটভাটার কোন তালিকা নেই। তবে সরেজমিন করে যে সকল ভাটায় লাকড়ি পোড়ানো হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানানো হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার সদস্য সচিব কামরুল হাসান পাঠান কামাল জানান, উপজেলার বেশিরভাগ ইটভাটাই লাইসেন্সবিহিন ও নিতিমালা বর্হিভূত ভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। রহস্যজনক কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর নির্বিকার স্থানীয়ভাবে ইউএনও এবং বনবিভাগ তদারকি করলে হয়তো কিছুটা অনিয়ম দূর হতো। উপজেলা ইটভাটা তদারকি কমিটির সদস্য ও নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদুর রহমান (অতিরিক্ত দায়িত্বে) জানান, তার অফিসে ইটভাটার কোন তালিকা আছে কিনা, তা তার জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে বলতে পারবেন বলে তিনি জানান। পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের পরিচালক দিলরুবা ইয়াসমিন জানান, ভালুকা উপজেলায় যেসকল ইটভাটার পরিবেশের ছাড়পত্র নেই, অভিযানের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে অচিরেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।