সজিনা গাছকে বলা হয় পুষ্টির ডিনামাইট। আর সজিনা পাতাকে বলা হয় অলৌকিক পাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর হার্ব। গবেষকরা বলছে সজিনা পাতা হচ্ছে নিউট্রিশন্স সুপার ফুড। পুষ্টি ও ওষুধি গুনাগুনের কারণে সুপার ফুড সবার পরিচিত এই সজিনা। কালীগঞ্জ বিভিন্ন উপজেলায় বাণিজ্যিক ভাবে শুরু হয়েছে সজনি পাতার চাষ শুরু হয়েছে। অধিকাংশ বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জমি, রাস্তার পাশে কৃষকরা সজিনা গাছ লাগিয়ে থাকে। তবে এবার বাণিজ্যিক ভাবে জমিতে সজিনার চাষ করা হচ্ছে পাতা সংগ্রহের জন্য। শতাধিক কৃষক সজিনাকে বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ করছে। কৃষকরা কাঁচা সজিনা পাতা প্রতি কেজি বিক্রি করছেন ৮ টাকা দরে। আর প্রতি কেজি শুকনা পাতা বিক্রি করছেন ৪০০ টাকা কেজি। লাভজনক হওয়ায় গৃহিনীরা বাড়ির কাজের পাশাপাশি এই কাজে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কৃষক ও গৃহিনীদের কাছ থেকে সজিনা পাতা ক্রয় করছে জিটি মরিংগা নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
কালীগঞ্জ উপজেলার ভোলপাড়া গ্রামের সজিনা চাষী তৌহিদুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, বাড়ির পাশে প্রায় ২ বিঘা জমিতে সজিনা চাষ করছেন। মুলত তিনি পাতা বিক্রির জন্য এইটি চাষ করেছেন। তবে সজিনা গাছ থেকে সজিন্া তিনি বিক্রি করবেন। হাইব্রিড ওডিসি-৩ জাতের সজিনা তিনি চাষ করেছেন। তৌহিদ জানান, সজিনা পাতা ও ডাটা দুটোই পাওয়া যায়। প্রতি কেজি কাঁচা পাতা বিক্রি করেন ৮-১০টাকা দরে। আর শুকনো পাতা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। বারোমাসি সজিনা গাছ লাগানোয় বারোমাই পাতা ও ডাটা সংগ্রহ করা যায়। তৌহিদ জানান, সজিনা চাষে তেমন খরচ নেই। এছাড়াও এর মধ্যে সাথি ফল হিসেবে পেয়াজ, রশুন, মশুরি চাষ করা যায়।
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সজিনা গাছকে অলৌকিক গাছ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আট রকম অত্যাবশ্যক এমাইনো এসিডসহ ৩৮% আমিষ থাকে যা বহু উদ্ভিদে নাই। সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আধার। এ ছাড়া শুকনো সজিনার পাতায় উচ্চ মাত্রায় পুষ্টি থাকে।
এ গাছের প্রতি গ্রাম পাতায় গাজরের চারগুণ বেশি ভিটামিন এ, দুধের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ক্যালশিয়াম, কলার চেয়ে ৩ গুণ বেশি পটাসিয়াম, কমলালেবুর চেয়ে সাতগুণ বেশি ভিটামিন, দইয়ের চেয়ে ২ গুণ বেশি প্রোটিন আছে। বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, সজিনা পাতায় ৪২% আমিষ, ১২৫% ক্যালসিয়াম, ৬১% ম্যাগনেসিয়াম, ৪১% পটাশিয়াম, ৭১% লৌহ, ২৭২% ভিটামিন-এ এবং ২২% ভিটামিন -সিসহ দেহের আবশ্যক বহু পুষ্টি উপাদান থাকে। ফলে এটি অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতাসহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতিজনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।সজিনার পাতাকে এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি বলা হয়। ৪৬ রকমের এন্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান। সিড বেডের আকার ১ মিটার প্রস্থ ও জমির আকার অনুযায়ী লম্বা করা যেতে পারে। তবে বেডের চতুর্দিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩০-৫০ সেমি. আকারে ড্রেন রাখতে হবে। অতঃপর বীজ, বেডে ১০-১৫ সেমি. দূরে দূরে লাইন করে বপন করতে হবে। ৫০-৬০ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়। চারা গজানোর থেকে শুরু করে চারা উঠানো পর্যন্ত সীডবেড আগাছামুক্ত ও সেচ প্রদান করতে হবে।
কৃষকরা জানান,সজিনার ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি গর্তে পচা গোবর/কম্পোস্ট ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৫০ গ্রাম, ইউরিয়া ১০ গ্রাম, এমওপি/পটাশ- ১০০ গ্রাম, জিপসাম- ১০ গ্রাম, দস্তাসার-১০ গ্রাম ও বোরন সার- ১০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া রাসায়নিক সার না দিয়ে প্রতি গর্তে ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর সার গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ওই গর্তে সাথে সাথে চারা লাগানে যায়। প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি. এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ৫০ গ্রাম করে সার দুপুর বেলায় সূর্যের আলো গাছের উপর পড়লে, গাছ যে পরিমাণ জায়গায় ছায়া প্রদান করে, সেই পরিমাণ জায়গায় গাছের চতুর্দিকের মাটি কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি বছরে প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর ঠিক রেখে ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট সার ২০ গ্রাম করে বর্ধিত হরে প্রয়োগ করতে হবে।
একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে ১৬০০টি পর্য়ন্ত সজিনার ফল বা ডাটা উৎপাদন হবে। বারোমাসি চারা লাগানোর ৬ মাস পর থেকে ফল ধরবে এবং তা সারা বছর পাওয়া যাবে। সাধারণত বছরে ২০টি ফলে ১ কেজি সজিনা হয়। এ হিসেবে ১টি গাছ থেকে বছরে ২ মণ সজিনা উৎপন্ন হবে। যা বিক্রি করে ৬৮০০ টাকা পাওয়া যেতে পারে। বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করলে ১ বিঘা জমিতে ৪০টি গাছ রোপণ করে ১,৫৬ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
কালীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বলরামপুর গ্রামের কৃষাণী মাধুরি রানী জানান, তিনি নিজের বাড়ির আঙিনায় সজিনা চাষ করছেন। এছাড়্ওা এলাকার নারীদেও বাড়ির আঙিনায় সজিনা চাষ করতে উৎসাহ দিচেছন। তিনি জানান, নারীদের কাছ থেকে সজিনা কাঁচা পাতা ৮-১০ টাকা দরে এবং শুকনো পাতা ৪০০ টাকা কেজি ক্রয় করে নিচ্ছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসার মো: মাহবুব আলম রনি জানান, পুষ্টি ও ওষুধি গুনাগুনের কারণে সবার পরিচিত সজিনা গাছ। মুলত কার্টিং রোপন বা বীজ রোপন করে সজিনা গাছ তৈরি করা যায়। তিনি আরো জানান, কৃষি অফিসের পরামর্শ অনেক কৃষক,গৃহিনী বাড়ির আঙিনায় ও রাস্তার পাশে এই গাছ রোপন করে। তেমন রোগবালাই এবং পরিচর্যা করা লাগে না। তিনি জানান, কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কৃষক/কৃষানীদের সজনি গাছ লাগানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: আলমগীর হোসেন জানান, সজিনাতে ক্যালশিয়াম,খনিজ লবন,আয়রসহ প্রোটিন ও শর্করা জাতীয় উপাদন রয়েছে। এ ছাড়া গাছের বাকল, পাতা,ফুল,ডাটা ব্যাবহাওে ওষুধি গুন রয়েছে। তিনি জানান, সজিনা পাতা এন্টিসেপটিভ হিসেবে ব্যভহার করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সজিনার পাতার পাউডার দিয়ে ক্যাপসুল তৈরি করে বানিজ্যিক ভাবে বাজারযাত করছে।