শীত এলে কে না ভালোবাসে ভোর সকালে খেজুরের রস খেতে। কিন্তু এই খেজুরের রস খাওয়াই অনেক মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। যার প্রধান কারণ এই নিপাহ ভাইরাস। বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাবের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। মানুষ যখন দূষিত কাঁচা খেজুরের রস পান করে তখন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। সেই ব্যক্তি তখন তাদের পরিবারের সদস্য বা স্বাস্থ্য-কর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়। এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে ৭৭ শতাংশ। এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো কোনো টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। সচেতনতা ছাড়া আপাতত আর কোনো রক্ষাকবচ মানুষের হাতে নেই। ফলে আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টাই এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ করণীয়। এই ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যেতে রস খাওয়ার আট থেকে ৯ দিন সময় লাগে। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো ৬-১১ দিন পরে প্রদর্শিত হয়। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার শুঙ্গাই নিপাহ গ্রামে নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণ প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। ওই গ্রামের নামানুসারেই ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়। ভাইরাসটির মুখ্য বাহক হচ্ছে ফলভোজী ফ্লাইং ফক্স শ্রেণির বাদুড়। এই বাদুড়ের মূত্র, বিষ্ঠা, লালা কিংবা শুক্রাণুতেও ভাইরাসটি বাস করতে পারে। মরার সময় এই বাদুড়ের দেহ নিঃসৃত পদার্থ পরিবেশে ছড়ালে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা দেখা দেয়। বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের মূলে চিহ্নিত হয়েছে খেজুরের রস পান। শীতকালে খেজুরের গাছে এবং রসে বাদুড়ের স্পর্শ স্বাভাবিক। বাদুড় রাতের বেলায় খেজুরের রসের নালি থেকে চেটে চেটে রস খায়। ওই স্পর্শে তার দেহ নিঃসৃত পদার্থ খেজুর রসকে কলুষিত করে। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত সপ্তাহে রাজশাহীতে একজন নারী মারা গেছেন। আক্রান্ত হওয়ার আগে তিনি খেজুরের রস খেয়েছিলেন বলে জানা গেছে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত ২০ বছরে দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে এতে আক্রান্ত হন ৩২২ জন মানুষ। তাদের মধ্যে মারা যান ২২৯ জন। দেশে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা খুব বেশি নয়। তবে এ রোগে মৃত্যুর হার বেশি। চলতি বছরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৮ রোগীর মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে, ভাইরাসটি ছোঁয়াচে, খুব দ্রুত ছড়ায় এবং আক্রান্তদের প্রায় সবাই স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ-জনিত রোগটি বিশ্বে মহামারি সৃষ্টি করতে পারে। যদিও প্রতিষেধক হিসেবে এর ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে তবে সেটা কবে নাগাদ তা পাওয়া যাবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় সচেতনতাই ভাইরাসটির বড় প্রতিষেধক। তাছাড়া রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় আক্রান্তদের পরিচর্যার সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যেহেতু বাদুড়ই এ ভাইরাস ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম, তাই বাদুড় থেকে মানুষকে দূরে থাকার ব্যাপারে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। যেসব এলাকার মানুষ নিপাহ ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হয় সেসব এলাকায় সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করতে হবে। শীত মৌসুম এলেই নিয়মিত প্রচার চালাতে হবে। আর তাহলেই আমারা আরেকটা বৈশ্বিক মহামারী থেকে রক্ষা পাবো।