দেশে নানান সমস্যা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে প্রতিনিয়ত এদেশের মানুষকে টিকে থাকতে হয়। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক একটি সমস্যার নাম ‘আর্সেনিক দূষণ’। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে খাবার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত হার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। আর্সেনিক মূলত একপ্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। কিন্তু যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়ে যায় তখনই তা পানকারীর শরীরের নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে সেই সকল রোগব্যাধিকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী ১ লিটার পানিতে ১০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানি দূষিত। আর্সেনিক একটি বিষাক্ত খনিজ মৌলিক পদার্থ। এটি বিষক্রিয়ার দিক থেকে পারদের চেয়ে চার গুণ বেশি শক্তিশালী। এর কোনো স্বাদ বা গন্ধ নেই। আর্সেনিকের পারমাণবিক সংখ্যা ৩৩ এবং পারমাণবিক ভর ৭৪.৯। অর্ধপরিবাহী ও শংকর ধাতু তৈরিতে আর্সেনিক ব্যবহৃত হয়। এটি মৌলিক পদার্থ হিসেবে থাকলে পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং বিষাক্তও হয় না। কিন্তু বাতাসে জারিত হয়ে অক্সাইড গঠন করলে এটি বিষাক্ত হয়ে ওঠে। মানুষের দেহে, মৃত্তিকায় এবং সমুদ্রের পানিতে সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক লক্ষ্য করা যায়। মাটির উপরিভাগের চেয়ে অভ্যন্তরে আর্সেনিক বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। মাটির নিচে পাথরের একটি স্তর আছে যাতে পাইরাইট্স নামে একটি যৌগ আছে। এই যৌগে আর্সেনিক বিদ্যমান। দেশে আর্সেনিক সমস্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। বিদেশি কিছু সংস্থা, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সম্প্রতি আর্সেনিক দূষণের ওপর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বাদ দিয়ে ব্যাপক জরিপ চালিয়েছে। এতে দেশের পঞ্চাশের অধিক জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের দূষণমাত্রা গ্রহণ সীমার ঊর্ধ্বে পাওয়া গেছে। বিগত কয়েক দশক যাবত কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে ফলে তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করছে নদী, নালা, খাল, বিল এবং সমুদ্রের পানি। এই অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার আর্সেনিক দূষণের একটি অন্যতম কারণ। মাটির বিশেষ যে স্তরে আর্সনোপাইরাইট নামক পদার্থ আছে ভূ-গর্ভস্থ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে তা পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্রতিদিনের মোট আর্সেনিক গ্রহণ ও প্রস্রাবে আর্সেনিকের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। পানিতে আর্সেনিক বেশি থাকলে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে সাধারণ রোগে গড়ে মৃত্যুঝুঁকি ২১% এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুঝুঁকি ২৪% বেড়েছে। আর্সেনিক আক্রান্ত ব্যক্তি ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর জিহ্বা, মাড়ি, ঠোঁটে লালভাব দেখা যায়। ক্ষুধামন্দা, খাদ্যে অরুচি এবং বমিবমি অনুভব করে। ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মানুষের রক্তে শ্বেত ও লোহিত কণিকার পরিমাণ কমে যায়। অনেক সময় রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত এবং গর্ভবতীদের ভ্রƒণের মারত্মক ক্ষতি হয়। আর্সেনিক কোনো সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নয় তাই আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। খাবার পানির মাধ্যমে আর্সেনিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, তাই আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। এমতাবস্থায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে আরও ব্যাপক কর্মসূচির মাধ্যমে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের সচেতন করতে হবে। যক্ষ্মা, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি রোগের মতো এ রোগকেও নির্মূল করার পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণকে সচেতন হতে হবে এবং আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় সরকারকে নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক এলাকায় আর্সেনিক দূষণমুক্ত নলকূপের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই এই ব্যাধি থেকে দেশের জনগণ মুক্তি পাবে।