২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্ব মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করে। সহিংস হামলার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসে, যাদের গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এটি সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করা মানুষের নজিরবিহীন এক ঢলের সূচনা করেছিল। মিয়ানমার থেকে জাতিগত নিধন ও দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত প্রায় দশ লাখ নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। প্রাথমিকভাবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশ্রয় দেয়া হলেও, ক্রমেই এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ-অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি ও বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট আজ একটি বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি গভীরতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের পর সমস্যাটি যে এতটা জটিল হয়ে উঠবে, তা আমারা কেউই ভাবতে পারিনি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট-পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে মাঝেমধ্যে কিছু আশার কথা শোনা গেলেও সার্বিক বিচারে এই সময়ে তৈরি হওয়া বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে সংকট আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের পুরো অঞ্চলটির নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সমস্যাটি মিয়ানমার তৈরি করেছিল, এর সমাধান অবশ্যই মিয়ানমারের করা উচিত। তিন বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও একটি রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থানের ফলে নানা রকম আর্থসামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিবিরে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা ও বঞ্চনা বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বৈষয়িক টানাপড়েন ও মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে নানারকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা, বাংলাদেশের পাসপোর্ট তৈরি করা, এমনকি ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের তৎপরতায় তাদের লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। তাদের কারণে আমাদের দেশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুনের শিকারও হয়েছেন বেশ কয়েকজন। রোহিঙ্গা নেতাসহ কয়েকজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে এক ভলান্টিয়ারকে হত্যা করেছে একদল দুষ্কৃতকারী। উখিয়ার পালংখালী ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই খুনের ঘটনা ঘটে। এদের প্রত্যাবাসন না হওয়ায় ওই এলাকার নিরাপত্তা হুমকি বাড়ছে। এতে মানবিক সংকটও বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাগত যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে রোহিঙ্গা সমস্যাটি এখন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গা সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে এবং এর সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারের হাতেই তাই মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশকে জোরালো ও বিচক্ষণ কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালু রাখতে হবে। সর্বোপরি জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতাদের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। অবশ্যই নিজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখ-তা ও জাতীয় স্বার্থই হবে বাংলাদেশের জন্য প্রধান, প্রথম ও শেষ বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের জন্য বাকি সব বিবেচনা হবে গৌণ, মুখ্য নয়।