রাজধানীতে বিভিন্ন ভবনে একের পর এক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে নগরবাসীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর মাঝে কোনো কোনো ভবন ধসে পড়ছে। মাঝে মাঝে ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। প্রকৃত রাজধানীতে কত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এর প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই। সংশ্লিষ্ট সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় প্রায় প্রতিদিন ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। অন্যদিকে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। যদিও কেন ঘটছে এসব ঘটনা, তা নিয়ে নেই বলার মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। তবে অভিযোগ উঠেছে, ভবন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের পকেট ঠিকই ভারি হচ্ছে। ঝুঁকিতে থাকা এসব ভবনে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার পরেও সেপটিক ট্যাংক, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না। অথচ আবাসিক ভবনগুলোর অ্যাপার্টমেন্ট মালিক ও ভাড়াটিয়া, শপিংমল ও মার্কেটের দোকান মালিক ও ভাড়াটিয়ারা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষনের জন্য টাকা দিয়ে আসছেন। ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। তদারকি সংস্থাগুলোরও নজরদারি নেই। চলতি সপ্তাহে চারটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩০ জন। যেখানে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে একটি ভবনে বিস্ফোরণে তিন জন মারা যাওয়ার ক্ষতই এখনো শুকায়নি, সেখানে ওই ঘটনার দুই দিন পরই বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সিদ্দিকবাজার। পুরাণ ঢাকার সিদ্দিকবাজারে সাততলা একটি ভবনে বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২৩ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বুয়েটের একাধিক বিশেষজ্ঞ, রাজউকের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সিদ্দিকবাজারের ঘটনার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাফে কুইন ভবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শুরুতে ছিল তিনতলা ভবন। পরে তা আরও চারতলা বাড়ানো হয়। কিন্তু রাজউক কিছুই জানে না। তারা বলে, ভবনের মাটির নিচের জলাধার, পাইপলাইন, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভবনে তা মানা হচ্ছে না। রাজধানীর পুরাণ ঢাকা একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। সেখানে ২৫ হাজার ভবন আছে, যার ৯০ শতাংশের কোনো অনুমোদন নেই। আবার যেসব ভবন আছে, সেগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশই আছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার তালিকায়। তার পরও সেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। এ অবস্থায় বড় ধরনের ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড ঘটলে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতিসাধনও হবে। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে পুরাণ ঢাকাকে বাসযোগ্য নিরাপদ শহরে পরিণত করতে হলে সেখানকার ৮০ শতাংশ ভবন ভেঙে সড়ক প্রশস্ত করণসহ অন্যান্য কমপ্লায়ন্স ঠিক রেখে নির্মাণ করতে হবে। নয়তো অনেক জায়গায় লিকেজ তৈরি হতে পারে, যা থেকে হতে পারে মারাত্মক বিস্ফোরণ। শহরের ভবনগুলোতে অভ্যন্তরীণ সংযোগ লাইনগুলোও নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় না। যার ফলে প্রায়শই শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে রাস্তার পাশের ভবনগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন, যা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে পুরো ভবনকেই। আবার স্যুয়ারেজের লাইন ঠিক না থাকায় বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম না থাকার কারণে গ্যাস জমে যাচ্ছে সেপটিক ট্যাংকে। এর বাইরে শীতের শেষের দিকে এসি বিস্ফোরণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো নিম্নমানের এসি ব্যবহার করা এবং গরমের সময় কয়েক মাস বন্ধ রেখে সার্ভিসিং না করিয়েই এসি ব্যবহার করা। এ ছাড়া পুরনো ভবনগুলোর ভেতরে একসঙ্গে অনেক এসি ব্যবহার করা হয় নির্ধারিত দূরত্ব না মেনেই। এগুলোর কোনো একটিতে গ্যাস লিকেজ হলে সবগুলোই বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এসব দুর্ঘটনার পেছনে গ্যাসের জরাজীর্ণ পাইপলাইন এবং পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্দশাই দায়ী। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের তদারকির অভাবে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় চারটি সিটি করপোরেশন রয়েছে। এসব সিটি এলাকায় ২১ লাখের বেশি ভবন ও স্থাপনা রয়েছে। এর সঙ্গে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন যোগ করলে এই সংখ্যা ২৫ লাখ ছাড়াবে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এসব ভবনে প্রায় ২৮ লাখ ৫৮ হাজার সংযোগ দিয়েছে। এর বাইরে রয়েছে অবৈধ সংযোগ। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এসব সংযোগ থেকে গ্যাস জমে যেকোনো সময় গুলিস্তানের মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেহেতু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে একের পর এক গ্যাস-সংযোগ থেকে দুর্ঘটনা ঘটছে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এসবের জন্য তিতাসসহ গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা ও দুর্নীতি দায়ী। তাদের অবহেলায় অনেক ভবনের গ্যাসোলিন একেকটি ঘুমন্ত বোমায় পরিণত হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত, গুলিস্তানের ওই দুর্ঘটনার জন্য তিতাসসহ সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তারা তদন্ত করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে। দায় চাপায় ভোক্তাদের ঘাড়ে। এগুলো বন্ধ না করলে মৃত্যুর এই মিছিল থামবে না। ভবন তৈরিতে সঠিক নিয়ম অবলম্বন ও সচেতন হতে হবে।