ঈদকে সামনে রেখে অনেকে ঋণ নিয়ে বাড়তি পুঁজি খাটিয়েছিলেন ব্যবসায়। পাইকারি কেনাবেচার জন্য মজুদ করা হয়েছিল পোশাক। তবে অগ্নিকাণ্ডের সাথে পুড়ে গেছে ব্যবসায়ীদের সেই স্বপ্ন। ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের হিসাবে, টিন-কাঠের অবকাঠামোতে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দোকানের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আবার কর্পোরেশনের কাগজপত্রে এই বিপণিবিতান দোতলা। কিন্তু কমপ্লেক্সের কিছু অংশ তিনতলা। এই বিপণিবিতানের মালিক সমিতির নেতারা যে যার সুবিধামতো দোকান বাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কমপ্লেক্সের কিছু তৈরি করে নিয়েছিলেন। দোকানিরা কেউ ১৫ বছর, কেউ ২০ বছর আগে গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছিলেন জীবন বদলাতে। দোকানে চাকরি করে কয়েক বছরের বেতনের টাকা জমিয়ে একসময় নিজেরাই দোকান দিয়েছিলেন। ব্যবসাও দাঁড়িয়েছিল তাঁদের। ১৫-২০ লাখ টাকার মূলধন হয়েছিল কারও কারও। কিন্তু আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব তাঁরা। বঙ্গবাজারের কাঠের মার্কেটের পুড়ে যাওয়া দোকানের স্মৃতিচিহ্ন বলতে শুধু কয়লা আর ছাই। ঈদ উপলক্ষে এই ব্যবসায়ীদের অনেকে ব্যাংক, সমিতি ও আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় লগ্নি করেছিলেন। তাঁদের দাবি, সব হারিয়ে এখন তাঁদের কাঁধে ঋণের বোঝা। ঋণের এ বোঝা কীভাবে কমাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঋণগ্রস্ত বেশির ভাগ ব্যবসায়ী। আগুনে শুধু মালামালই পোড়েনি, দোকানগুলোর বাক্সগুলোতে জমানো লাখ লাখ টাকাও পুড়েছে। পুড়েছে আয়-ব্যয়ের হিসাব, ব্যাংকের চেকসহ প্রয়োজনীয় নানা ধরনের কাগজ।
মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে পোশাকের দোকানে আগুন লাগে। খবর পেয়েই সেখানে ছুটে যান ব্যবসায়ী ও দোকানের কর্মীরা। সকালে আগুন লাগার খবরটি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোনের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসকে জানান এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একটা সময় তা আশপাশের ভবনেও লেগে যায়। ঢাকা ও আশপাশের তিন জেলার ২২টি স্টেশন থেকে ৪৮টি ইউনিট এবং ৬৫০ জন সদস্য আগুন নেভাতে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার আগুন নেভানো ও শৃঙ্খলার কাজে নানাভাবে সহায়তা করে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ততক্ষণে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পুরোটাই পুড়ে গেছে। আশপাশের বিপণি বিতানগুলোর দোকানও পুড়েছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে দেখা যায়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আশপাশের ভবন ও বিপণিবিতান থেকে আধপোড়া ও রক্ষা পাওয়া মালামাল বের করছেন ব্যবসায়ীরা। রাত নয়টায় পাওয়া খবর অনুযায়ী, এনেক্সকো টাওয়ারে আগুন নেভানোর কাজ করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়ার কারণ তিনটি: ১. উৎসুক জনতার কারণে আগুন নেভানোর কাজে বিঘ্ন। ২. পানির অভাব। ৩. বাতাসের বেগ। অবশ্য ব্যবসায়ীদের কারও কারও অভিযোগ, ফায়ার সার্ভিস নিজেদের সদর দপ্তর ও সরকারি স্থাপনার দিকে যাতে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে মনোযোগী বেশি ছিল। এ অভিযোগ তুলে ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের একটি অংশ উত্তেজিত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে হামলা চালায়। অগ্নিনির্বাপণের দায়িত্বে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্যকেও মারধর করা হয়। ফায়ার সার্ভিস বলছে,ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে চার বছর আগেই অগ্নি-নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। তখন ফায়ার সার্ভিস থেকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে বেশ কিছু ব্যানারও টাঙানো হয়েছিল। সবাই জানত এই কমপ্লেক্স বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু এরপর সরকারের অন্য কোনো সংস্থা কিংবা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকান মালিকেরা অগ্নিঝুঁকি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
অণ্যদিকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের একটি বিপণিবিতানের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের বিপণিবিতানের তিনতলায় শুধু সমিতির কার্যালয় এবং একটি মসজিদ করা হয়েছিল। অন্য তিনটি বিপণিবিতানের প্রায় পুরোটাই তিনতলা পর্যন্ত করে কারখানা করা ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। জহিরুল ইসলাম দাবি করেন, ফায়ার সার্ভিস ভুল করে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ব্যানার টাঙিয়েছিল। তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবনকে আমরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছি এবং ব্যানার টাঙিয়েছি। এরপর ১০ বার নোটিশ দিয়েছি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব ছিল, আমরা করেছি। তারপরও এখানে ব্যবসা চলছে। কিন্তু মালিক সমিতি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বঙ্গবাজারে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তবে উল্লেখ্য ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বঙ্গবাজারের জায়গায় বহুতল ভবন করা হবে বলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মনে এখন আরেক শঙ্কা ভর করেছে, পুড়ে যাওয়া দোকানের জায়গায় তাঁরা নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন কি না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আগে বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার পর এমন দেখা গেছে প্রকৃত দোকানিরা আর দোকান ফেরত পাননি, অন্য কেউ তা দখল করে নিয়েছেন। এবারও অনেকের বেলায় এমন হতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের। এ পরিপ্রেক্ষিতে দোকান মালিক সমিতি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যাতে নিজ নিজ দোকান ফিরে পান, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবিও জানিয়েছে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যাপ্ত অনুদান দেবেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন,‘কোনো দুর্যোগ হলে প্রথম কাজ হলো উদ্ধার তৎপরতা। সেটি মঙ্গলবার সম্পন্ন হয়েছে।‘ এখন মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করে পরিপূর্ণভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ও পাশে থাকব। এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তালিকা করে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার পরই সব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত-ভাবে তিনি অনুদান দিবেন। যাতে তাঁরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।