একসময় আমন ধান চাষের পর জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যেত। তাই বৃথা পরিশ্রম হবে ভেবে চাষাবাদের চেষ্টাও করতাম না। তবে গত বছরই প্রথম এসব পতিত জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে কম খরচে অধিক ফলন পেয়েছি।’ খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদি ইউনিয়নের পাটুলিয়া গ্রামের কৃষক কালিপদ সরকার এভাবে জানাচ্ছিলেন সূর্যমুখী চাষের শুরুর কথা। গত বছর ১৬ শতাংশ পতিত জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছিলেন তিনি। কম খরচ ও অল্প পরিশ্রমে লাভবান হওয়ায় এবার দুই বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর চাষাবাদ করেছেন এই কৃষক। এভাবে গত বছর থেকে কয়রা উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের অনেক কৃষক সূর্যমুখীর চাষ করে লাভবান হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি সূর্যমুখীর চাষ হচ্ছে আমাদি ইউনিয়নে। ইউনিয়নটিতে গত বছর ৪ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছিল। আর এবার ২৫ হেক্টর জমিতে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের খুলনা কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হারুনর রশীদ বলেন, কয়রা উপজেলার নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায়ই লোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। ফলে শুধু আমন ধান ছাড়া কোনো ফসল হয় না। উপকূলের এসব লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখীর উৎপাদন বাড়াতে পারলে একদিকে যেমন অনাবাদি জমির পরিমাণ কমবে, অন্যদিকে দেশে ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এ ফসল চাষে খরচ এবং পরিশ্রম দুটোই কম হওয়ায় লাভের পরিমাণ বেশি। এসব দিক বিবেচনা করে স্থানীয় কৃষকেরা সূর্যমুখী চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কয়রা সদরের কৃষক রবীন্দ্রনাথ ঢালী এক বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। তাঁর খেতে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে ফুটে আছে হলুদ সূর্যমুখী ফুল। সবুজের মধ্যে হলুদ ফুলগুলো অপরূপ সৌন্দর্যে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রবীন্দ্র ঢালী বলেন, ফলন ভালো দেখে স্থানীয় অনেক কৃষক সূর্যমুখীর বীজ সংরক্ষণ করার অনুরোধ করেছেন। কয়রা উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে গত বছর ২০০ কৃষক প্রায় ৪০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করেছিলেন। এবার তা বেড়ে ৮৮ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। বেড়েছে কৃষকের সংখ্যাও। এবার ৬৫০ জন কৃষক উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহযোগিতায় নিজ নিজ জমিতে এ ফুলের চাষ করেছেন। এ ছাড়া সরেজমিন কৃষি বিভাগ বিভিন্ন এলাকায় সুর্যমুখী চাষ করার জন্য সহযোগিতা করেছে। বৈজ্ঞানিক সহকারি জাহিদ হাসান বলেন, সুর্যমুখী চাষে বাম্পার ফলন হয়েছে কয়রায়। গতকাল মঙ্গলবর দুপুরে উপজেলার আমাদি ইউনিয়নের পাটুলিয়া গ্রামের কিষান-কিষানিরা ব্যস্ত ছিলেন সূর্যমুখী গাছের পরিচর্যায়। কেউ খেতের আগাছা দমন করছিলেন, কেউ গাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ ছেঁটে ফেলছিলেন। কিষানি ব্রতী রানী বলেন, ‘আমি চার বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করিছি। এতে তেমন পরিশ্রম নেই। আবার বেশি সেচও লাগে না। কৃষি অফিস থেকে বীজ ও সার দেওয়া হয়। আর খেত পরিচর্যার কাজটা ভালোমতো করতি পারলি অনেক লাভবান হওয়া যায়।’ একই গ্রামের কৃষক চন্ডীপদ সরকার বলেন, ‘গত বছর দুই বিঘা জমি চাষাবাদে আমার খরচ হয়িছিল ২৫ হাজার টাকা। সূর্যমুখীর বীজ বিক্রি করিছিলাম ৭০ হাজার টাকা। লাভ হয়িছে ৪৫ হাজার টাকার মতো। তাই এবারও সূর্যমুখীর চাষ করিছি।’ কয়রায় সূর্যমুখী চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাস। তিনি বলেন, এক মণ সূর্যমুখীর বীজ থেকে ১৮-২০ কেজি তেল উৎপন্ন হয়। প্রতি কেজি তেল বিক্রি হয় ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। বর্তমানে সূর্যমুখী তেলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে এ ফসল উৎপাদনের আগ্রহ বাড়ছে।