খুলনার পাইকগাছায় নাছিরপুর-তালতলা খালের পুণ:খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্পের একাংশ তালতলা খালের দেড় কিমি. খননে দুর্নীতি-অনিয়মের মধ্যে শেষ করতে যাচ্ছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে তারা খাল থেকে সকল স্কেভেটর মেশিন উঠিয়ে প্রকল্পের অপর অংশ নাছিরপুরে ঢুকিয়েছে। একটি মাত্র স্কেভেটরে তালতলার প্রবেশ পথে খালের গভীরতায় সমতলের স্পিলিংয়ের কাজ করছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বলা হচ্ছে, ৩ মিটার গভীরতায় মাটি কাটার কথা। আর বাস্তবতা বলছে, সেখানে কাটা হয়েছে মাত্র এক থেকে দেড় মিটার। যদিও এর জন্য তারা প্রতিকূল পরিবেশকে দায়ী করছেন। এরইমধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে স্লুইচ গেট দিয়ে পানি ঢোকানোর। ঠিকাদারের নিয়োগকৃতরা বলছেন, মাটি কেটে রাখলে তা আবার নিচে নেমে আসছে। এক বছর মেয়াদে এমন খালের কর্তন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সর্বশেষ কাজের অগ্রগতি দেখে চলতি মেয়াদে বাস্তবায়ন নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে এলাকাবাসীর পাশাপাশি খোদ মৎস্য অধিদপ্তরেও। জানাযায়, প্রকল্পে কার্যাদেশ প্রাপ্তির প্রায় এক বছর পর দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে তালতলা খালের প্রায় ২ কিমি. এবং মার্চের মাঝামাঝিতে নাছিরপুর মূল খালের ৯ কিমি. পুণ:খননের কাজ শুরু হলেও বেশি দূর এগুতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এরই মাঝে একদিকে বর্ষার তাড়া অন্যদিকে লবণ পানি উত্তোলনের তোড়জোড় শুরু হওয়ায় কাজ শেষ করা নিয়ে আশঙ্কা ক্রমশ দানা বাঁধছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব সুযোগ কেউ কাজে লাগাতে চাইছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এদিকে এখন পর্যন্ত কাজের সফলতা ধরে রাখতে নাছিরপুর খালের একাধিক স্থানে ক্লোজার নির্মাণ করে খনন কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আকস্মিক বৃষ্টি কিংবা স্লুইচ গেট দিয়ে পানি ঢুকে যাতে কার্যক্রম ব্যাহত না হয় সে কারনেই মূলত ক্লোজারগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। তবে চিংড়ী চাষ অধ্যুষিত জনপদে উৎপাদন মৌসুমের এখন পর্যন্ত লবণ পানি তুলতে না পারায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিংড়ী চাষ। তবে লিংক খালটির মুখে অগ্রভাগে ক্লোজার নির্মাণ করায় সেটাও কাটা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা, একদিকে তালতলা খালটিও যেনতেন কেটে সংযোগমুখে একটি মাত্র স্কেভেটরে মাটি স্পিলিংয়ের কাজ করা হচ্ছে। অন্যদিকে সালতা নদী সৃষ্ট নাছিরপুর খালের সংযোগ মুখে স্লুইচ গেটটি খুলে দিলে তালতলার আগে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়বে নাছিরপুর মূল খালে। এতে খাল পুণঃখনন কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হবে। এলাকাবাসী বলছেন, প্রকল্পে শুরুতে তালতলা খাল পুণঃখনন কাজ শুরু হলেও তা শেষ না করেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দায়সারা খনন করে একটি বাদে সমুদয় স্কেভেটর নাছিরপুর খালে সরিয়ে নিয়েছে। আসলে বিষয়টি তাদের পরিকল্পনাহীনতা নাকি দূরভিসন্ধী তা খতিয়ে দেখারও দাবি উঠেছে। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য যাই হোক দীর্ঘ দিন খালগুলি পানিশূণ্য থাকায় মাছশূণ্য রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মৌসুমের প্রায় ৪ মাসেও পানি তুলতে না পারায় সেখানকার মাছ চাষীরা এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার চিংড়ী উৎপাদন করতে পারেনি। আর এজন্য তারা যৌথভাবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও মৎস্য বিভাগের দায়িত্বহীনতা, খামখেয়ালিপনা, দুর্নীতি অনিয়মকেই দায়ী করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাসটেইনেবল কোস্টাল এ- মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পে খুলনার পাইকগাছায় সালতা নদীর শাখা সংযোগ নাছিরপুর-তালতলা ৯ কিমি. মূল খালের খনন ও পোদা নদী খননে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। গত বছরের ৬ এপ্রিল। আর শেষ হওয়ার কথা ছিল ঐ বছরের ৩০ মে। টেন্ডারে প্রকল্পটির কার্যাদেশ পায় কুষ্টিয়ার শহীদুল ইসলামের মালিকানাধীন ইউনুচ এ- ব্রাদার্স। সে লক্ষ্যে ২১ এপ্রিল ২২’ স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু খনন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। তবে ঐসময় খালে পানি পরিপূর্ণসহ নানাবিধ প্রতিকূলতায় নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু করতে না পারায় বন্ধ থাকে খনন কাজ। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকল্পের আওতায় প্রথমে তালতলা খালের ২ কিমি. এলাকার পূর্ণখনন কাজ শুরু হয়। এরপর মার্চের মাঝামাঝিতে মূল নাছিরপুর খালের প্রায় ৯কিমি. পূণ:খননের কাজ শুরু হয়। তবে দ্বিতীয় দফায় কাজ শুরু হলেও নতুন করে প্রকল্প সাইনবোর্ড দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এদিকে লবণ পানির চিংড়ী চাষের উপর নির্ভরশীল এলাকাবাসী খাল খননের কারণে উৎপাদন মৌসুমের ৩ মাস অতিবাহিত হলেও নদী থেকে পানি তুলতে না পারায় মারাতœকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অন্যদিকে লবণ পানি না ওঠায় কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শে চিংড়ীর ঘেরে ধান চাষ করে ঠকেছেন কৃষকরা। কৃষি অফিসের পরামর্শে উদ্বুদ্ধ কৃষককূল ধানের আবাদ করলেও পরে কৃষি বিভাগের যথাযথ নীরিক্ষণ ও অব্যবস্থাপনায় মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার দরুণ বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে রাতারাতি ধান মরে সাবার হয়ে গেছে। ফলে পানির অভাবে যেমন মাছ চাষ হয়নি তেমনি অতিরিক্ত লবণাক্ততায় ধান চাষেও উৎপাদন ভাল হয়নি। খাল খননের ব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. টিপু সুলতান বলেন, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় গত বছর খননকাজ শুরু করা যায়নি। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে চলতি বছরের শুরুতে খননকাজ শুরু হলেও আসন্ন বর্ষা মৌসুম ও স্থানীয় প্রতিকূলতায় চলতি মৌসুমে কাজ শেষ করা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরেজমিনে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ২ কিমি. মতান্তরে দেড় কিমি. তালতলা খাল খননে ৩ মিটার বা প্রায় ১০ ফুট গভীরতায় খনন করার কথা থাকলেও ঠিকাদার কোথাও এক মিটার, কোথাও দেড় আবার কোথাও ২ মিটার পর্যন্ত গভীরে কর্তন করেছে। এ ছাড়া উজান মুখে ক্রমশ কম গভীরতায় কর্তন করেছে। অনেক এলাকায় আবার নরম পলি মাটি ধ্বসে বা সরে ফের খালের অভ্যন্তরে পড়েছে। এক কথায় খালের মাটি খালের সীমানায় রেখে স্কেভেটরের বুমের বাকেট টেনে স্লোপসহ গভীরতা দেখিয়ে কাজ সম্পন্ন করেছেন। যদিও প্রথম দিকে স্কেভেটরের চালকরা বলেছিলেন তারা প্রসেসিং করছেন পরে মূল খনন করা হবে। তবে বাস্তবে তার ঠিক উল্টো চিত্র। এদিকে মূল নাছিরপুর খাল খননে নাম জটিলতার কারণে প্রথমে এর খনন শুরু করা যায়নি। পরে কর্তৃপক্ষ খননস্থল পরিদর্শনপূর্বক জটিলতার অবসান ঘটিয়ে মার্চের মাঝামাঝিতে ৯ কিমি. নাছিরপুর খালের খনন কাজ শুরু করেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এখানেও ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিচ্ছেন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা টিপু সুলতান আরো বলেন, দু’টি খালের একই ১০ ফুট গভীরতা ও উপরিভাগ যেখানে যেমন প্রস্থে অর্থাৎ ৭০/৮০/ বা ১০০ ফুট এবং পরিমাণমত তলদেশ খনন কাজ করা হচ্ছে। যদিও বাস্তব চিত্র তার উল্টো। তিনি বলেন, সময় ও পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে খননকাজ এগিয়ে নিতে নাছিরপুর খালের উত্তর সীমানায় রাস্তার পাশে প্রথমে মাটি কেটে বুকড করছেন। প্রসঙ্গত, বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কানাইডাঙ্গা, গোয়ালবাথান, কাশিমনগর, নাছিরপুর, রেজাকপুর, উ: সলুয়া, দ: সলুয়া, নগরশ্রীরামপুর মৌজার উপর দিয়ে প্রবাহিত নাছিরপুর খালটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম। বর্ষা মৌসুমে কাজ বন্ধ থাকায় বিস্তীর্ণ উপরিস্থলের পানি নিষ্কাশনে খালের কর্তনকৃত মাটি ফের ধুঁয়ে খালে পড়ে ভরাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সময় খালের মুখে সালতার সংযোগস্থলের স্লুইচ গেটটি খোলা থাকায় জোয়ারে পলিবাহিত পানি উত্তোলন অন্যদিকে উপরিভাগের নিষ্কাশিত বর্ষার পানি খালে পড়ে অল্প দিনেই ফের ভরাটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর এমনটি হলে সরকারের খাল খননের মহতি উদ্যোগ বহুলাংশে ভেস্তে যেতে পারে বলেও ধারণা অনেকের। এদিকে খাল খননের বরাদ্দ ও খনন পরিধির ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভাল বলতে পারবেন। এ ব্যাপারে নাছিরপুর খালের ইজারাদার উত্তর সলুয়া আদর্শ মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি লুৎফর রহমান জানান, খাল খননের কারণে পানি ওঠা-নামা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দার বলেন, খাল খননের স্বার্থে শুরুতেই তিনি খালের পানি শুকানোর ব্যবস্থা করেছেন। তবে দীর্ঘ দিন ধরে প্রসঙ্গত, সরকার সামুদ্রিক একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে মৎস্য জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে চিংড়ি, তলদেশীয় এবং ভাসমান প্রজাতির মৎস্যের মজুদ নিরূপন কর্মসূচি জোরদারকরণ, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা সংস্থার সামর্থ্য বৃদ্ধিপূর্বক বিজ্ঞানভিত্তিক টেকসই মৎস্য মজুদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, বাণিজ্যিক ও ক্ষুদ্রায়তন মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে অধিকতর কার্যকর পরিবীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী (এমসিএস) পদ্ধতির বাস্তবায়ন, উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, সার্ভিস সেন্টার, মৎস্যবাজর উন্নয়নকরতঃ আহৃত ও উৎপাদিত মৎস্যের ভ্যালু চেইন উৎকর্ষ ও গুণগতমান উন্নয়ন ও অপচয় হ্রাস করা, উপকূলীয় জেলা সমূহে ক্লাস্টার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সম্প্রসারণ ঘটিয়ে বাগদা চিংড়ির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও চিংড়ি রপ্তানী বৃদ্ধি করা, দরিদ্র মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠি কর্তৃক চালিত তাঁদের নের্তৃত্বে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ-এর টেকসই সহ-ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা এবং বিকল্প জীবিকায়নে সহায়তা করা, উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ এর টেকসই আহরণ ব্যবস্থাপনায় ‘সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ প্রণয়ন, উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্রসকাটিং ইস্যুর ওপর সমীক্ষা পরিচালনার জন্য সারাদেশে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। স্থানীয়রা জানান, সালতা নদী থেকে সংযোগ খাল তালতলা নাছিরপুরে স্লুইচ গেটের মাধ্যমে পানি ওঠা-নামা করানো হয়। তবে দীর্ঘ দিন ধরে এর নিয়ন্ত্রণ খাল ইজারাদারদের হাতে চলে যাওয়ার দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে খালটিতে নেট-পাটা দিয়ে অবাধে মাছ চাষ করার ফলে অতিদ্রুত খালটির নব্যতা হ্রাস পেয়ে এর অপমৃত্যু ঘটেছে। একদিকে খালটির অপমৃত্যু অন্যদিকে চরভরাটি বিস্তীর্ণ জমিতে শুরু হয় দখল প্রতিযোগীতা। সর্বশেষ সরকার খাল খননের উদ্যোগ নিলেও অনেক এলাকায় দখল বজায় রাখতে শুরু হয় জটিলতা। সর্বশেষ সাসটেইনেবল কোস্টাল এ- মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় খালখননের হ-য-র-ব-ল অবস্থায় পানি ঢুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে চিংড়ী চাষীরা।