ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুমিল্লার হোমনা উপজেলায় বাড়ছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। মাথার ওপর প্রখর সূর্যের তাপ। প্রতিদিনই তাপমাত্রা ৩৭-৪০ ডিগ্রিতে উঠানামা করছে। গুমোট পরিবেশ আর ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিতে পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব। বিদ্যুৎবিভাগ বলছে, চাহিদার তুলনায় নগণ্য পরিমাণে বিদ্যুৎ পাওয়ায় তা বিতরণে হিমশীম খাচ্ছেন তারাও। গড়ে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পরিমাণ বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে। কেউ কেউ ফেইসবুকে বিদ্যুতের অসহনীয় এই লোডশেডিং নিয়ে ক্ষুব্ধ মতামত দিচ্ছেন। শওকত মোল্লা নামে এক গ্রাহক তার ফেইসবুক আইডিতে লেখেন, ‘আজকালের বিদ্যুৎ অধরা প্রিয়তমার ন্যায় রঙ বদলায়।’ আরেক ইউজার শফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিসিএস প্রশ্ন- কোন দেশে ইফতারি, সেহেরী আর তারাবির আগ মূহুতে বিদ্যুৎ চলে যায়?’
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, তীব্র লোডশেডিংয়ে উপজেলার চলতি রবি মৌসুমে বোরো ধানের জমিতে সেচকার্য বিঘিœত হচ্ছে। ফলে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করতে পারবে না। হিমাগারের আলুবীজ সংরক্ষণেও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। এ বিষয়ে কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-০৩ এর ডিজিএম শওকাতুল আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের ৭০ হাজার গ্রাহক রয়েছে। প্রতিদিন আমাদের পিক-অফপিক আওয়ারে ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরিতে গ্রিড থেকে আমারা মাত্র ৬ থেকে ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এর মধ্যে উপজেলা সদরের গুরুত্ব বিবেচনায় এখানে একটু বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ইউনিয়ন পর্যায়ে তুলনামূলক বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। সেখানে গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে; আর বাকী সময় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, চলমান গ্রীষ্ম মৌসুমে তীব্র দাবদাহ এবং পবিত্র রমজান মাসের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অত্যধিক বেড়ে গেছে। রামপাল ৫০০ মেগাওয়াট থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আশুগঞ্জ ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ও চট্টগ্রাম (রাউজান) ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ত্রুটির কারণে বন্ধ থাকা এবং হাটহাজারি ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের ‘পিটি’ বিস্ফোরণের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে।
কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলোর অভিযোগ, তাদের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। সারাদিনে নামমাত্র বিদ্যুতের দেখা পান। প্রচ- গরমে অতিষ্ঠ উপজেলার নিলখী ইউনিয়নের এক যুবক নূরে আলম সিদ্দিকী লোডশেডিংয়ের কারণে প্রশ্ন রাখেন, ‘ভাই আমগো দেশে কি কারেন্ট আইতো না?’ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ইকবাল হাসান শামীম। তিনি উপজেলা সদরে প্রিন্টিং ব্যবসা করছেন। তার মতে লোডশেডিংয়ের কারণে অর্ডার ঠিকমতো ডেলিভারি দিতে পারছেন না; নতুন করে অর্ডার রাখতেও পারছেন না। ফলে আয় কমে গেছে। সামনে ঈদ। এতে কীভাবে তিনি নিজের পরিবার এবং কর্মচারীদের সন্তুষ্ট করবেন এই ভেবে অস্থির।
উপজেলার চান্দেরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা স্থানীয় সাংাবাদিক সৈয়দ আনোয়ার জানান, ‘এই এলাকায় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। কয়েকদিন যাবত ইফতার, তারাবী ও সাহরির সময় বিদ্যুৎ থাকছেই না। বিদ্যুৎ কখনো দশ মিনিট, কখনো আধা ঘণ্টা থেকে চলে গেলে আবার দেড়-দুই ঘণ্টা পরে আসে। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না।’
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে আরও জানা গেছে, হোমনা উপজেলায় গভীর, অগভীর ও এলএলপি নলকূপের সাহায্যে ৫ হাজার ৪৪২ হেক্টর জমি চাষাাবাদ হয়ে থাকে। সেচকাজ চালু রয়েছে ৪ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে এবং বিদ্যুৎালিত ৮৪টি গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচের মাধ্যমে ১ হাজার ১৫২ হেক্টর ইরি ধানের জমি চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে উপজেলার ২৩ হাজার ৯৪৪ দশমিক ৮ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
বিদ্যুৎচালিত পাম্পের সাহায্যে নলকূপ স্থাপন করে নদী থেকে পানি তুলে দেড়শ বিঘা প্রকল্পের ইরি জমিতে সেচকার্য চালাচ্ছেন ঘারমোড়া ইউনিয়নের কালিপুর গ্রামের আবদুর রহিম। বর্তমানে ধান গাছে ধানের দানা দেখা দিয়েছে। ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা যাওয়ায় ঠিকমত সেচ দিতে পারছেন না তিনি। ফলে মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। সেচ দিতে না পারলে ধান চিটা হয়ে যাবে। তার মতো দুর্বিষহ অবস্থা অন্যান্য প্রকল্পেও। তিনি এ প্রতিবেদকের মাধ্যমে আগামী দশ থেকে পনেরো দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রাপ্তির দাবি জানিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বিদ্যুতের সমস্যার কারণে কৃষি খাতে ঝুঁকির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, বোরো ধানের আবাদের ক্ষেত্রে। ধানের এখন ফুল আসা এবং দানা গঠন পর্যায়ে রয়েছে। এমন সময়ে কৃষক নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেচকার্য বিঘিœত হওয়ার ফলে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষক ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পেলে আমাদের যে ২৩ হাজার ৯৪৪ দশমিক ৮ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অজন করা সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় বিদ্যুৎবিভাগসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর সমূহকে কৃষকদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত।’
বিএডিসি হোমনা উপজেলা আলু বীজ সংরক্ষণাগারের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলী মিয়াজী বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে হিমাগারের তাপমাত্রা ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আলুর বীজ গজে (জারমিনেশন) এবং পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে। এতে কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হবেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. শহীদ উল্লাহ বলেন, অত্যধিক গরমের কারণে শরীর থেকে ঘামের সঙ্গে প্রচুর লবন ও পানি বের হয়ে পানিশূন্যতাসহ হিট স্ট্রোক, হাইপোথার্মিয়া, ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। এর ফলে মৃত্যুও হতে পারে। এ অবস্থায় মানুষকে অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-০৩ এর ডিজিএম শওকাতুল আলম সহসাই এই পরিস্থিতির উন্নতি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে আসার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।