মরণ বাঁধ ফারাক্কার কারণে পদ্মা এখন ধুধু বালু চর নিয়ে লিখার জন্য খাতা কলম, তথ্য - উপাত্ত, নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসলাম এমন সময় বাল্য বিয়ের স্বীকার নবম শ্রেণীতে বিঞ্জান বিভাগে পড়া এক ছাত্রী মোবাইল করে বললেন স্যার বাল্য বিয়ে সর্ম্পকে একটু কিছু লিখেন, বর্তমানে বাল্য বিয়ে কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে, পিতা মাতা মেয়েদের বাল্য বিয়ে দেয়াটাকে মুখ্য আর পড়া লিখা করাটাকে গৌণ বলেই মনে করছেন। আপনার কলাম লেখার কারণে পিতামাতা সচেতন হবে, প্রশাসন কঠোর হবেন অনেক মেয়ে বাল্য বিয়ের হাত থেকে বেঁচে হবেন ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রভাষক, আইনবিদ, পুলিশ কর্মকর্তা, ইউএনও, ডিসি, বিচারকসহ বিভিন্ন পেশার বড় বড় স্তরে মেয়েরা প্রতিনিধিত্ব করবেন, দেশ সমাজ জাঁতি এগিয়ে যাবে।
আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদেরকে আদর্শ জাঁতি উপহার দিব। একটি সুস্থ্য জাঁতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা, বলেছিলেন প্রখ্যাত মনিষী ও দার্শনিক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। অথচ এ সকল মায়েদের শিক্ষিত তো দূরের কথা বাল্য বয়সে বিয়ে হচ্ছে তাদের। বাল্য বিবাহ সমাজে এখন একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাল্যবিবাহ আইন থাকলেও তার বাস্তবে প্রয়োগ করা হচ্ছেনা এ আইন। করোনা মহামারির কারণে বাল্যবিবাহ মারাত্মকভাবে বাড়ছে।
বাংলাদেশে করোনা মহামারির সময় বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের ঝরে পড়া বেড়েছে। কিন্তু দেশজুড়ে মোট ঝরে পড়া স্কুলছাত্রীর সংখ্যা কত তা নিয়ে এখনো সরকারি বা বেসরকারি কোনো জরিপ হয়নি।
বাল্যবিয়ের কারণে কী পরিমাণ স্কুলছাত্রী ঝরে পড়েছে সে সংখ্যা জানা না গেলেও কিছু বেসরকারি সংস্থা বলছে করোনার সময়ে দেশজুড়েই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ের ঘটনা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা বলছে, দেশে করোনার কারণে বাল্যবিয়ে শতকরা ১৩ ভাগ বেড়েছে। গত ২৫ বছরে যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ।
এদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ৷ আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৭ ভাগ। তবে করোনায় এ সংখ্যা বেড়েছে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও আগামী শিক্ষাবর্ষে ৭৭ লাখ বই কম ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে সাকিবুর রহমান বলেন, ‘‘করোনার সময়ে প্রধানত খরচ মেটাতে না পেরেই বাল্যবিয়ের এমন ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে অনলাইন ক্লাসের জন্য ইন্টারনেট ডাটা কেনা তাদের পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর অভিভাবকদের আয়ও কমে যায়।''
তিনি জানান, বিয়ে হওয়া এ ছাত্রীদের কেউই আর স্কুলে যাচ্ছে না। তিনি আরো দাবি করেন, স্কুল থেকেও বিবাহিত মেয়েদের স্কুলে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তারা মনে করছেন, ওই মেয়েরা স্কুলে গিয়ে বিয়ের গল্প করলে অন্য মেয়েরাও বিয়েতে উৎসাহিত হতে পারে। প্রেম প্রীতিতে জড়িয়ে পড়ায় বেশী বাল্যবিয়ে ঘটছে। আর যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই কাবিন নেই৷ ফলে বয়স নিয়ে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি।
বিশ্বে প্রতি ৭ সেকেন্ডে ১৫ বছরের কম বয়সী একটি কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয় ১০ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের অনেক বেশি বয়সী পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। আফগনিস্থাান, ইয়েমেন, ভারত, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিয়ের ঘটনা ঘটে। তবে ভারতে এ হার সবচেয়ে বেশি। কন্যাশিশুর বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম একটি। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়।
ইউনিসেফের মতে, বর্তমানে বিশ্বে ৭০ কোটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ৯৫ কোটিতে পৌঁছতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন, এর ফলে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যার প্রকট বাড়ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে।
বাল্যবিবাহ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বির্তক রয়েছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে আমাদের মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে মানুষ অনেক বেশি সচেতন। তারপরও দেশ থেকে এই ব্যাধি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্য বিবাহের হারের লজ্জা বাংলাদেশের। খবরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে প্রতি তিনটি বিয়ের দুটিতেই কনের বিয়ের বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার সর্বোচ্চ।
৬ মার্চ ২০১৮ বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বজুড়ে বাল্যবিয়ে কমছে, কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী? ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে বাল্য বিয়ে পনের শতাংশ কমে এসেছে। জাতিসংঘ বলছে, সারা বিশ্বে বাল্য বিবাহের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ তার এক প্রতিবেদনে বলছে, গত এক দশকে সারা পৃথিবীতে আড়াই কোটি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজনের বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই। কিন্তু এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিলো প্রতি চারজনে একজন। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে বাল্য বিয়ে পনের শতাংশ কমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৫০ শতাংশ থেকে এখন ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। বাল্য বিয়ের হার বাংলাদেশেও খুব বেশি ছিল, সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার হতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্পবয়সী মেয়েরাই এখন তাদের বিয়ে ঠেকাতে এগিয়ে আসছে। সচেতনতা বাড়ার পরেও কেন এই বিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না এই প্রশ্নের জবাবে নীনা গোস্বামী সামাজিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, "পরিবারে মেয়ে-শিশুকে এখনও একটি দায়ভার হিসেবে মনে করা হচ্ছে।" তিনি বলেন, আইনে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাল্য বিবাহ প্রতিরোধের লক্ষ্যে করা আইনের বিশেষ একটি ধারার কারণে এটা ততোটা কার্যকর করা হচ্ছে না।
ওই ধারাটিতে বিশেষ পরিস্থিতিতে মেয়েদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়াকে আইনসম্মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, ভারতে বাল্য বিবাহ কমানো সম্ভব হয়েছে নারীদের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে। তাদেরকে বাল্য বিয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বুঝিয়ে সচেতন করা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, বাল্য বিবাহের প্রবণতা এখনও সবচেয়ে বেশি আফ্রিকায়।
কিন্তু তারপরেও ইথিওপিয়াতে এধরনের বিয়ের সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাহারা মরুভূমির আশেপাশের দেশগুলোতে প্রতি তিনজন নারীর একজনের বাল্যকালেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এক দশক আগে এটা ছিলো প্রতি পাঁচজনে একজন। জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বিশ্ব নেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্য বিবাহের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যদি বলা হয়- ক্যান্সার, হৃদরোগ বা অন্যান্য জটিল ও প্রাণঘাতী রোগের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর বাল্যবিয়ে, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রাণঘাতী রোগে একজন আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি হয়। কিন্তু বাল্যবিয়ে একটা মেয়ে ও তার প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেয়। স্বাধীন সত্তা হিসেবে একজন বালেগা মুসলিম নারী যে কোনো মুসলিম পুরুষের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। অভিভাবক তাকে জোরপূর্বক বিবাহ দিলে তা কার্যকর হবে না। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪-এর খসড়া। প্রস্তাবিতাবিত খসড়া আইনে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ এবং পুরুষের জন্য ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করার প্রন্তাব করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯২৯ সাল থেকে আইনিভাবে আগের বয়সসীমা ২১/১৮ চালু আছে। সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধের নামে এই আইন পাস করার পথে হাঁটলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এর ফলে বাল্যবিবাহ আইনগত ভিত্তি পেতে যাচ্ছে। মেয়েদের বয়স কমিয়ে আনার বিষয়টি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কেননা মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ করাটা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ। প্রচলিত আইন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বাল্যবিয়ে সমাজে যে রীতি চালু রয়েছে যতটা না আইনের কারণে, তার চেয়ে বেশি প্রয়োগের অভাবে। নারী-পুরুষ মিলেই তো একটি পরিবার। ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশে বিয়ের গড় বয়স ১৫.৮ বছর। আগের তুলনায় এটা কমেছে।
কিন্তু এখনও ১৩-১৪ বছর বয়সেও অনেক বিয়ে হয়ে যায়। দরিদ্র বাবা-মা মনে করছে বিয়ে দিলেই মেয়ে ভালো থাকবে। আর্থ-সামাজিক নানা কারণেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হয়। আবার কোচিং প্রাইভেট বানিজ্য নিষিদ্ধ থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় ব্যাঙের ছাতার মত যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে এসব অবৈধ কারবার ফলে সেখানে ছেলে মেয়ে একসাথে পাঠদান করা হয়। অবাধে মেলা মেশার কারণে প্রেমপ্রীতি, অবৈধ গর্ভধারণ করায় বাল্য বিয়ে আশাংকা জনকভাবে বৃদ্ধি পাঁচ্ছে।
বাল্যবিয়ের প্রধান কুফল হচ্ছে অল্প বয়সেই তারা সন্তনের মা হয়। শিশুর পেটে আর এক শিশু এটা কি মেনে নেওয়া যায় ? আবার অনেক পরিবারে দেখা গেছে নববধূ বছর ঘুরতেই মা না হলে তার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শেষ থাকে না। নিকট অতীতে বাল্যবিয়ের প্রতিবাদে প্রাণ দিয়েছে কুড়িগ্রামের রিমা। জোর করে বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে রিমা আক্তার নামের ৭ম শ্রেণির এক মেধাবী ছাত্রী। বিয়েতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না রিমা। এ অবস্থায় রিমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় তার বাবা। এতে অভিমান করে রিমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
বিয়ের উপযুক্ত বয়স কোনটি? এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ একজন বালক ও বালিকার শারীরিক গঠন, স্থান, কাল ও পরিবেশভেদের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের একজন বালিকা যে বয়সে বিয়ের উপযুক্ত মনে করা হয় সেটা হয়তবা অন্য কোনো দেশে তারও আগে হতে পারে। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ কখনও ফরজ, কখনও ওয়াজিব, কখনও সুন্নাত আবার কখনো হারাম তথা নিষিদ্ধ।
অতএব সোনা, রুপা ও লোহা এক পাল্লায় ওজন করা হবে হঠকারী সিদ্ধান্ত। বিয়ের উপযুক্ত বয়সের সময়টা ভালো বুঝতে পারে ব্যক্তি নিজেই। তবে অভিভাবকদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ অভিভাবকরা তো এ সময়টা পার করেই বুড়ো হয়েছেন। অভিভাবকদের মনে রাখা দরকার অবিবাহিত ছেলেমেয়ে যদি অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হয়, তখন তার দায়ভার কিন্তু পিতা-মাতার ওপর বর্তায়। প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। বাল্য বিয়ে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন অভিভাবকের সচেতনতা ও আইনের শাসন। যে বয়সে একটি মেয়েশিশুর খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
মানসিক পরিপক্বতা না আসার কারণে তার পক্ষে অন্য সংসারে গিয়ে মানিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় নির্যাতন। আবার এও দেখা গেছে যে শারীরিক পরিপক্বতা আসার আগেই সন্তান ধারণা করার ফলে মেয়েটির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। একজন অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকে এ ধরনের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া কখনই কাম্য হতে পারে না। অথচ যুগের পর যুগ আমাদের সমাজে তা-ই হয়ে আসছে। আমরা আশা করি প্রশাসন ও স্থানীয় সচেতন মহলের মিলিত প্রয়াসে এই অভিশাপ থেকে আমাদের মেয়েরা মুক্তির পথ খুঁজে পাবে।
গত বছর মার্চ মাসে অন লাইল পত্রিকার আর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বে বছরে ‘বাল্য বিবাহের’ শিকার ১২ মিলিয়ন শিশু- ইউনিসেফ বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ১২ মিলিয়ন শিশু ‘বাল্য বিবাহের’ শিকার হয় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল- ইউনিসেফ।
ইউনিসেফ জানায়, বিশ্বে প্রতি চার জন কন্যা শিশুর মধ্যে এক জনকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিশ্বজুড়ে বাল্যবিবাহ রোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি শিশু বাল্য বিবাহের শিকার হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ইউনিসেফ। তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, পারিবারিক মূল্যবোধ ও জনসচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে এই হার আরও কমানো সম্ভব বলে জানায় সংস্থাটি। এদিকে, ভারত, বাংলাদেশ, চীন, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সুদানসহ আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় সেখানে শিশু জন্মের হার অনেকাংশেই বেশি। পাশাপাশি মাথাপিছু আয়, গর্ভকালীন জটিলতায় মাতৃ-মৃত্যুর হার ও অপুষ্টিজনিত শিশুর সংখ্যাও বেশি।
লন্ডনে সেভ দ্য চিলড্রেনের লিঙ্গসমতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গাব্রিয়েলে সাজাবো বলেন, দুঃখজনক বিষয় যে, মহামারি লিঙ্গ বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। করোনায় দিনের পর দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, মা-বাবারা চাকরি হারাচ্ছেন, লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি বাড়ছে সহিংসতা আর ধর্ষণ।
এসব কারণে কন্যার নিরাপত্তার কথা ভেবে মা-বাবারা তাদের নাবালক মেয়েদের জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন৷ বিয়ে হলে মেয়ে অন্তত ক্ষুধা আর বঞ্চনা থেকে রক্ষা পাবে বলে তাদের ধারণা।
এদিকে করোনার কারণে ২০২২ সালে কমপক্ষে আরো পাঁচ লাখ মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেনের গ্লোবাল গার্ল হুড প্রতিবেদনে।
২০২৫ সালের মধ্যে বাল্য বিবাহের শিকার হতে পারে আরো অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। ২০২৫ সালে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে মোট ছয় কোটি দশ লাখ হতে পারে বলে সংস্থাটি আশঙ্কা করছে।
এ বছর আগের তুলনায় আরো দশ লাখ বেশি কিশোরী গর্ভবতী হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরিকায়। আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি
প্রতি বছর বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। বাল্যবিয়ের এই চর্চা সামাজিক ও প্রথাগতভাবে হয়ে থাকে। তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে আরও নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছিল ১৩ হাজার ৮৮৬ টি। বিগত যে কোনো সময়েরে চেয়ে এই মাত্রা বেশি।
গত বছর ১১ মার্চ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বাল্যবিয়ের অবস্থা দ্রুত বিশ্লেষণ: করোনাকাল ২০২০’ বিষয়ক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৩ হাজার ৮৮৬টি। এর মধ্যে বরগুনা জেলায় এক হাজার ৫১২, কুড়িগ্রাম এক হাজার ২২২, নীলফামারীতে এক হাজার ২২২, লক্ষ্মীপুর এক হাজার ৪১ এবং কুষ্টিয়ায় ৮৮৪টি।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে সামগ্রিকভাবে পরিবারের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক আয় কমে যাওয়া, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বৃদ্ধি।
নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর লোকেরা গৃহস্থালীর আয় কমে যাওয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায় ধসসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। এসব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে উচ্চ সংখ্যক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটিয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, করোনার এই সময়ে পারিবারিক সহিংসতা, স্কুল বন্ধ এবং পড়াশোনার সময় অভাব, শেখার জন্য প্রযুক্তিগত সুবিধা ও ইন্টারনেটের অভাব কাজ করেছে।
করোনার এই সময় অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের প্রধান কারণ স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির চাহিদার কারণে ঘটেছে। এই সময়ে অপ্রত্যাশিত গর্ভাবস্থা ছিল পাঁচ হাজার ৮৯ জন। এর হার শতকরা ২৯ দশমিক দুই ভাগ।
কোভিড -১৯ এর এই সময় দীর্ঘকাল ঘরে বসে থাকায় স্বামীর কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক দশমিক পাঁচ শতাংশ নারী। পরিকল্পনা বা পরিষেবার অপ্রতুল অভাব ছিল এই সময়।
বাল্যবিয়ের কারণে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে এক দশমিক ছয় শতাংশ, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে ১২ দশমিক চার শতাংশ, মেয়েদের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে ১১ শতাংশ, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আট দশমিক দুই শতাংশ, শ্বশুরবাড়িতে এবং স্বামীর ঘরে মানসিক নির্যাতন বা অবহেলার শিকার হয়েছেন চার শতাংশ নারী।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, মিশ্র পদ্ধতিতে এই জরিপ পরিচালিত হয়েছে সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। প্রতিবেদন তৈরিতে ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতা করেছে।
ঢাকাসহ দেশের ২১টি জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও রয়েছে মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, রাঙ্গামাটি, কিশোরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চাটগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, জামালপুর, যশোর, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, টাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট। এসব জেলার ৮৪৮টি উপজেলা বা থানার ৪০৯টি ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহে পার্টনার সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের মাঝেও আনতে হবে সচেতনতা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আরও অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয়ভাবে যেসব সংগঠন কাজ করছে তাদের সবার সঙ্গে মিলে একটি জাতীয় পরিকল্পনা ঘোষণা করার এখনি সময়। সেই পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজে নেমে না পড়লে সামনে কী হবে তা বলা মুশকিল।
লেখক: মো. হায়দার আলী প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় সহঃ সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা।