একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম সূচক চায়ের ভোগ্যতা। বাংলাদেশে চা খাত সাধারণ মানুষের ভোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের পর থেকেই চায়ের বিপণন অর্ধেকে নেমে গেছে। বাগানে উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও নিলাম থেকে ফেরত আসায় গুদামে চা জমছে। এতে বাগানগুলোর পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে এবং পরিচালন খরচ মেটাতে না পারায় বাধ্য হয়ে দেশের অধিকাংশ চা বাগানই উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও এ বছর অতিরিক্ত গরমে চায়ের কুঁড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে এবারের মৌসুমে অনাবৃষ্টি আর প্রচণ্ড গরমের কারণে সমতলের চা চাষ এবং উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। রোদের তাপে চা-গাছে লাল মাকড়সা, থ্রিপস, লুপারসহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ বেড়েছে। এতে কাঁচা চা-পাতার উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। এ ছাড়া এসব রোগবালাইয়ের আক্রমণ থেকে বাগান বাঁচাতে চাষিদের অতিরিক্ত কীটনাশক ছিটানো ও সেচ দিতে গিয়ে খরচ বেড়েছে।
এবার এপ্রিল মাসজুড়ে সবচেয়ে বেশি গরম ছিল। গত বছরের এপ্রিল মাসে উত্তরাঞ্চলে ৪২ লাখ ৭৪ হাজার ৫৪৫ কেজি কাঁচা চা-পাতা থেকে ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯০৯ কেজি চা (তৈরি চা-পাতা) উৎপাদন করা হয়েছিল। তবে চলতি মৌসুমের এপ্রিল মাসে প্রায় ২০ লাখ কেজি কাঁচা চা-পাতা থেকে প্রায় চার লাখ কেজি চা (তৈরি চা-পাতা) উৎপাদন করা হয়েছে। সমতলে চা চাষের জন্য ২৬ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনীয়। কিন্তু এবারের মৌসুমে আমরা বেশির ভাগ সময় এই এলাকায় ৩৫ ডিগ্রি থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠানামা করেছে। কিন্তু চা চাষের জন্য বছরে দুই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। সে তুলনায় এবার আমরা সামান্য পরিমাণে বৃষ্টিপাত পেয়েছি। তবে উৎপাদন বাড়াতে চা বাগানগুলোতে বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জনপ্রিয় জাতগুলোর চাষ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
দেশের উৎপাদিত চায়ের বড় অংশই এখন আসে মৌলভীবাজারের বাগানগুলো থেকে। দেশের যত চা উৎপাদন হয় তার ৫৫ ভাগই আসে এই জেলার বাগানগুলো থেকে। কিন্তু সংস্কারের কারণে এ বছর মৌলভীবাজারের বাগানগুলোতে উৎপাদন কম হয়েছে। সিলেট অঞ্চলের বাইরে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা থেকে আসে উৎপাদিত চায়ের দশ ভাগ। সমতলের চা বাগানেও গত বছরের তুলনায় উৎপাদন কম। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য চাষিদের অবশ্যই চা-বাগানে ছায়াবৃক্ষ হিসেবে কড়ই ও শিরীষ গাছ লাগাতে হবে এবং চা-বাগানে স্প্রিংক্লার ইরিগেশন সেচের মাধ্যমে সেচ দিতে হবে। রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াও খরচ কমাতে জৈব পদ্ধতির সমন্বিত বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া পোকামাকড় দমনে আলোর ফাঁদ ও হলুদ ট্র্যাফ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগ না করে পরিমিত সার প্রয়োগ করতে হবে। কেননা প্রতিকূল আবহাওয়ায় চা উৎপাদনে দুর্দিন চলছে। নানা রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। বাগানগুলোতে সদ্য লাগানো চারাগাছ মরে যাচ্ছে। তাই সরকারের বিভিন্ন এলাকার চা-চাষিদের জন্য সচেতনতামূলক কর্মশালার আয়োজন করা প্রয়োজন। তাহলে হয়তো চা-চাষীরা আবার চায়ের বিপণন বৃদ্ধি করতে পারবে।