বিগত মেয়রগণ নগর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তেমন কোন উন্নয়ন করতে পারেনি। তাই আগামী ২১ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হলে কেউ দিচ্ছেন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে স্মার্ট তিলোত্তমা নগরী গড়ার। আবার কেউবা বলছেন, ব্যবসায়ীক নগরী কিংবা শিক্ষা বান্ধব নগরী গড়ে তোলার।
মেয়র প্রার্থীরা প্রায় সবাই উন্নয়নসহ সামগ্রীক কাজ করে পুরো নগরীকে সর্বোচ্চ আধুনিকায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। মেয়র প্রার্থীদের কৌঁসুলি প্রচারণায় নগরীর সর্বত্র এখন বিরাজ করছে নির্বাচনী আমেজ। বরিশাল সিটি নির্বাচনে ছয়জন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধীতার মাঠে থাকলেও ভোটারদের কাছে আলোচনায় রয়েছেন তিনজন মেয়র প্রার্থী। তারা হলেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, চরমোনাই পীরের ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা মার্কার প্রার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম ও জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙল মার্কার প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস।
তবে অতীত শিক্ষায় এবার ভোটাররাও উল্টো কঠিন হিসেব করতে শুরু করেছেন। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মুখে প্রতিশ্রুতি যতোই দেওয়া হোকনা কেন, এবার তারা প্রার্থী বিবেচনায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। কারণ হিসেবে ভোটাররা বলেছেন, যে প্রার্থী সরাসরি সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ এনে নগর উন্নয়নে কাজ করতে পারবেন তাকেই আমরা ভোট দিবো। নতুবা ভুল প্রার্থী নির্বাচিত হলে আগামী পাঁচবছরের জন্য ফের বরিশাল নগরী পিছিয়ে যাবে। যেমনটি হয়েছিলো আহসান হাবিব কামাল মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর। পাশাপাশি নতুন নতুন ফতোয়ার কবলে পরতে হবে বলেও সচেতন ভোটাররা উল্লেখ করেন।
উন্মুক্ত সিটি করপোরেশন হবে ॥ সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেছেন, আমি মেয়র নির্বাচিত হলে বরিশাল সিটি করপোরেশন হবে একটি উম্মুক্ত সিটি করপোরেশন। সর্বসাধারণের প্রবেশে কোনো বাঁধা নিষেধ থাকবে না। আধুনিক বরিশাল বির্নিমানে অগ্রাধিকার ও প্রত্যাশা শীর্ষক মতবিনিময় সভার প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে খোকন সেরনিয়াবাত আরো বলেছেন, নগরবাসীর সবধরনের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্যই উন্নয়নের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দিয়ে বরিশালে পাঠিয়েছেন। এখন নগরবাসী আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে আমি কথা দিচ্ছি জনগণের সেবক হবে সিটি করপোরেশন। নগরীর বগুড়া রোডের ক্রাউন কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নুরুল আলম। আধুনিক বরিশাল বিনির্মানে অগ্রাধিকার ও প্রত্যাশা শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, আয়োজনের সমন্বয়ক এনায়েত হোসেন শিবলু। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, নারী নেত্রী অঞ্জলী দে, আইনজীবী আনিসুদ্দিন শহিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কবীর ভুলু, রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মিজানুর রহমান, সামাজিক আন্দোলনের নেতা আজিজ শাহিন প্রমুখ।
মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হবে ॥ গত দশবছরে বরিশালবাসী কোন মানবিক সেবা পায়নি। উল্টো বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বরিশালবাসীর সেবা করার জন্য পাঠিয়েছেন। এখানে দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে আবেদন আমি যাতে সেই কাঙ্খিত সেবা দিতে পারি। এজন্য আগামী ১২ জুন আমাকে নৌকা মার্কায় নির্বাচিত করার মাধ্যমে সুযোগ তৈরী করে দিবেন। আমি মেয়র নির্বাচিত হলে এখানের সকল সমস্যা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। রোববার বেলা ১২ টায় বরিশাল নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনী প্রধান কার্যালয়ের উদ্বোধণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কথাগুলো বলেছেন, সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাকির হোসেন ভুলু, সংরক্ষিত কাউন্সিলর আয়শা তৌহিদ লুনা, কামরুন নাহান রোজি, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য অসীম দেওয়ান, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন, বিএম কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক ভিপি মঈন তুষার প্রমুখ। একইদিন সকালে নৌকার প্রার্থী নগরীর বান্দ রোড ও নতুন বাজারের ব্যবসায়ী এবং পথচারীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
আসছে দুই কমিটির ১০৬ সদস্য ॥ সিটি নির্বাচনে বরিশালের নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারনার জন্য যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের নির্দেশে ১০৬ সদস্য বিশিষ্ট দুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দদের সমন্ময়ে গঠিত কমিটি দুইটি হলো নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ও সমন্বয়ক টিম। তাদের অধীনে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে তিনজন করে একটি দল দায়িত্ব পালন করবেন। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক ও নৌকার প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য নিজামুল ইসলাম নিজাম বলেন, এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের নিয়ে কাজ করবো।
প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নাটকীয় অভিযোগ ॥ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘণ করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে বরিশাল সদর আসনের সাংসদ ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণার অভিযোগ তুলেছেন জাতীয় পার্টি। এ-সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ নিয়ে জাপা মনোনীত মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক অধ্যাপক মহসিন উল ইসলাম হাবুল রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। তবে অভিযোগের সাথে প্রমান নিতে না পারায় তা গ্রহণ করেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পক্ষে যে জায়গাতে প্রতিমন্ত্রীর অবস্থানের কথা বলা হয়েছে, সেই এলাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী এলাকার মধ্যে নয় বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
শিক্ষা বান্ধব নগরী গড়ে তোলা হবে ॥ সিটি নির্বাচনে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা মার্কার মেয়র প্রাার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেছেন, আমি মেয়র নির্বাচিত হলে বরিশালে গরীব, দুঃখী ও মেহনতি মানুষ তাদের নাগরিক অধিকারের পূর্ণাঙ্গ ভোগ করতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা বান্ধব নগরী গড়ে তোলা হবে। দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বরিশালকে একটা শান্তির নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সবার জন্য সুশাসন ও সবাইকে নিয়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ বরিশাল মহানগর শাখার আয়োজনে ওয়ার্ড প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র প্রার্থী এসব কথা বলেছেন।
জাপা প্রার্থীর অভিযোগ ॥ জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, নগরীতে দখলবাজির নগ্ন উৎসব চলছে। আগে ভাতিজার আমলের মাছবাজার, লঞ্চঘাট, স্পীডবোড ঘাট, বাসস্ট্যান্ড এখন চাচার বাহিনীর লোকজনে দখল করে নিয়েছে। বিগত পাঁচবছর দিনের অফিস রাতে বাসভবনে করেছে, আগামীতে কোথায় অফিস করবেন তা সময় বলে দেবে। তারা নির্বাচন করতে আসেনি দখল করতে এসেছে। তিনি আরও বলেন, গত পাঁচ বছরের দুঃশাসনের কথা মানুষ ভুলতে পারেনি। নতুন করে হুন্ডা আর গুন্ডা বাহিনীর তান্ডব শুরু হয়েছে। আমরা দুঃশাসন থেকে মুক্তি চাই। জাতীয় পার্টির নির্বাচনী প্রধান কার্যালয়ে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাথে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় লাঙল মার্কার প্রার্থী এসব কথা বলেছেন।
পাঁচদিন কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ॥ আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ও পরে মিলিয়ে জনগনের নিরাপত্তা দিতে মাঠে পাঁচদিন কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি নগরীর ১২৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সাধারণ কেন্দ্রে ১৬ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জনের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সূত্রমতে, প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে পুলিশ, আনসার ও ভিডিপির ১৬ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জন সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এরমধ্যে সাধারণ কেন্দ্রে চারজনের হাতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে পাঁচজনের হাতে থাকবে অস্ত্র। পাশাপাশি পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের মোবাইল ফোর্স। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) টিম এবং বিজিবি ভোটের এলাকায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত থাকবে। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকার নিকটবর্তী নদী পথে দায়িত্ব পালন করবে নৌ-পুলিশ। ভোটের আগে ও পরে মিলিয়ে তারা সর্বোচ্চ পাঁচদিনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করবেন। এদিকে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতের জন্য নির্বাহী এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিভিন্ন অপরাধ আমলে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচারকাজ সম্পন্ন করবেন।