বিশ্ব পরিবেশ দিবসে রাজশাহী নগরীতে রাস্তা অবরোধ করে প্লাস্টিক ধর্মঘট পালন করা হয়েছে। আর একই সময়ে ‘প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে-সামিল হই সকলে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সারাদেশের মতো রাজশাহীতেও দিবসটি নানা আয়োজনে উদ্যাপন করা হয়। সোমবার (৫ জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবসটি উদ্যাপনে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এক আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণীর আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরউল্লাহ্, এনডিসি বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে তারা প্লাস্টিক ব্যবহারের পরে যেখানে সেখানে ফেলে না; কিন্তু আমাদের দেশে আমরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি, এটা আমরা স্বাধীনতা মনে করলেও আসলে এটা স্বাধীনতা নয়। আমাদের বুঝতে হবে স্বাধীনতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা এক নয়। তাই সিঙ্গাপুরের মতো আমাদের দেশেও এমন আইন করার সময় এসে গেছে। আমরা স্মার্ট দেশে রূপান্তর হতে যাচ্ছি। আমাদের চিন্তা-চেতনা আরও আধুনিক করতে হবে।
তিনি বলেন, পরিবেশ আমাদের রক্ষা করতেই হবেই; তা না হলে আমাদের সব সাফল্য বিলীন হয়ে যাবে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের বিভিন্ন দিক থাকলেও এবার বিশ্ব পরিবেশ সংস্থা প্লাস্টিক দূষণের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। প্লাস্টিক যখন উৎপাদন শুরু হয়েছিল তখন এর ক্ষতিকর দিক পর্যালোচনা করে দেখা হয়নি। মানুষও তখন অতটা সচেতন ছিল না। পরে ১৯৭৪ সাল থেকে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিকের বিপরীতে সোনালি আঁশ পাট ও কাগজের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা যদি পাট ও কাগজের ব্যবহার বৃদ্ধি করে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে ফেলতে পারি তা হলেই আজকের এই প্রতিপাদ্য সফল হবে। সুন্দর পরিবেশ গঠনে নিজেকে সচেতন হতে হবে এবং আশেপাশের সকলকে সচেতন করতে হবে। আর পরিবেশের দিক থেকে রাজশাহী অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি এই সফলতা ধরে রাখতে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন- রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নরেশ চাকমা, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার সামসুন নাহার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আবদুল্লা আল-মারুফ। এ সময় বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে বিভাগীয় কমিশনার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এ সময় সকল শিক্ষার্থীদের একটি করে গাছ উপহার দেওয়া হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় রাজশাহী পর্যটন মোটেল হতে এক বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে শেষ হয়। র্যালি শেষে বিভাগীয় কমিশনার বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে দিবসটির উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে একটি বকুল ফুলের চারা রোপণ করেন।
এদিকে মহানগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে রাস্তা অবরোধ করে আয়োজিত প্লাস্টিক ধর্মঘট পালনকালে বক্তারা বলেন, প্লাস্টিকের ভয়াবহতা, প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারণে পরিবশের বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাণবৈচিত্র্য ও মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা আজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পলিথিনের কারণে সবুজ উন্নয়নে বাঁধা হতে পারে আমাদের সবুজ শহর রাজশাহী নগরীর। এমনকি প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারনেই ধ্বংস হতে পারে আমাদের দেশ ও বিশ্বের প্রাণবৈচিত্র্য। চারিদিকে সর্বগ্রাসী প্লাস্টিক ও পলিথিনের রাজত্ব, এ যেন আমাদের সমস্ত জীবকুল ও পরিবেশের দখলদারিত্ব নিয়ে নিচ্ছে। তাই প্লাস্টিক ও পলিথিনের এমন ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতেই উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্টান বারসিক ও বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের যৌথ আয়োজনে আমরা রাস্তা অবরোধ করে প্লাস্টিক ধর্মঘট পালন করছি। প্রতিকী এ প্লাস্টিক ধর্মঘটে বিভিন্ন ফেস্টুন ও প্লেকার্ডে প্লাস্টিক তাঁর নিজের ভয়াবহতার কথা জানান দেয় এবং একই সাথে প্লাস্টিক ও পলিথিন প্রতিকী হিসেবে ১০ মিনিট রাস্তা অবরোধ রাখা হয়। এ ধর্মঘটে রাজশাহীর বিভিন্ন তরুণ সংগঠনের প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজ অংশগ্রহণ করে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক এবং এর ভয়াবহতার নানা দিক সম্মিলিত লিখা প্লেকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন।
এসময় বক্তারা বলেন- প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মনুষ্যসৃষ্ট নানা উন্নয়ন দূর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব, যুদ্ধ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার পাশাপাশি বিশ্ব আজ প্লাস্টিক দূষণ ও প্লাস্টিকের জন্য ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। প্লাস্টিকের জন্য আজ প্রাণবৈচিত্র্যসহ আমাদের সুন্দর পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্লাস্টিকের কারণে মানব স্বাস্থ্য মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে। একই সাথে জনজীবন ব্যাপকভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। প্লাস্টিক সমগ্র দুনিয়াকে গ্রাস করছে, যেন বিধ্বংসী প্লাস্টিকের রাজত্ব চলছে। প্লাস্টিকের জন্য পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, চারিদিকে প্লাস্টিকের জন্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় এমনকি আমাদের এই সুন্দর নগরের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে।
বারসিক’র গবেষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইউনাইটেড নেশনস’র পরিবেশ কর্মসূচির এক যৌথ গবেষণায় ৯০ শতাংশ পাখি এবং মাছের পাকস্থলী থেকে প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ সামুদ্রিক প্রজাতির মধ্যে এ নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। আর মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের দেহে প্রবেশের কারণে ব্রেইন ড্যামেজ, অবিসিটি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ, এ্যাজমাসহ নারীর বন্ধ্যাতের¡ মারাত্বক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তাই রাজশাহী মহানগর এবং আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে প্লাস্টিকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা এখন সময়ে দাবি।
বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম’র সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল’র সভাপতিত্বে এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাক আতিকুর রহমান আতিক’র সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন- ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-এর সভাপতি শামীউল আলীম শাওন, রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ও ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব টুনকু, আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সভাপতি নকুল পাহান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাগরণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি রাসেল সরকার, গ্রীণ ভয়েজ রাজশাহীর সমন্বয়ক আবদুর রহীম প্রমুখ। এ সময় তারা সবুজ শহর রাজশাহীতে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধসহ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০০২ এবং মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়ন নিশ্চিতের দাবি জানান।