আসন্ন বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণা এখন তুঙ্গে। প্রতিদিন মাইকিং, পোস্টার, লিফলেট ও পথসভার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। পাড়া-মহল্লায় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারনায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। তবে এবার গতানুগতিক প্রচারের সাথে যুক্ত হয়েছে নানা কৌশল। শ্লোগানে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে।
ডিজিটালের ছোঁয়ায় প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়াসহ মার্কা ও দলের পরিচিতি তুলে ধরা হচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় বিভিন্ন গান নির্বাচনী প্রচারে সংযুক্ত করে। প্রার্থীদের প্রচারে যুক্ত হয়েছে ‘নির্বাচনী গান’। গানের মাধ্যমে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন প্রার্থীরা। এতে বিনোদন পাঁচ্ছেন কর্মী ও ভোটাররা।
নগরী ঘুরে দেখা গেছে, আগে শ্লোগান দিয়ে প্রার্থীর পক্ষে মাইকিংয়েও লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া। জনপ্রিয় সব গানগুলোর সুর ঠিক রেখে কথাগুলোর জায়গায় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নাম ও গুণগান বসিয়ে শিল্পীদের দিয়ে গান রেকর্ড করানো হয়েছে। সেই রেকর্ড প্রচারনার মাইকে বাজানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার মার্কার মেয়র প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, জাতীয় পার্টির লাঙল মার্কার মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস, টেবিল ঘড়ি মার্কার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপন সহ বিভিন্ন কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারনায় জনপ্রিয় গানের সুর ও বাজনায় রের্কড করা নির্বাচনী গান প্রচার করতে দেখা গেছে। তবে বাজনা না থাকলেও ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা মার্কার মেয়র প্রার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের প্রচারণায় রয়েছে সুরে সুরে ইসলামীক গজল। এছাড়াও কিছু প্রার্থীকে পথশিল্পীদের নিয়ে সরাসরি গানের মাধ্যমে প্রচারণা করতে দেখা গেছে।
আমি ক্ষমতা লোভী নই ॥ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থী প্রধানমন্ত্রীর ফুফাতো ভাই খোকন সেরনিয়াবাত বলেছেন, আমি ক্ষমতা লোভী নই। আমার যদি ক্ষমতার লোভ থাকতো, তাহলে অনেক আগেই আপনারা আমাকে রাজপথে দেখতে পেতেন। সেই সুযোগও আমার ছিলো। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে বরিশাল নগরবাসীর প্রয়োজনে, বরিশাল সিটির উন্নয়নের জন্য আমাকে দলীয় প্রার্থী করে পাঠিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে এসেছি। নগরবাসীদের সাথে নিয়ে সারাদেশে চলমান বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বরিশাল সিটিকে একটি আধুনিক সমৃদ্ধশালী, স্মার্ট ও নতুন বরিশাল হিসেবে গড়ে তোলাই হচ্ছে আমার লক্ষ্য। নৌকার প্রার্থী আরও বলেন, আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে আমাকে মেয়র নির্বাচিত করা হলে রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বরিশাল সিটি করপোরেশন সকলের জন্য উম্মুক্ত করে দিবো। জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যদের সাথে নির্বাচনী মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে খোকন সেরনিয়াবাত এসব কথা বলেছেন। সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোঃ ইউনুস, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম। আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফয়জুল হক ফয়েজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন মুন্সি।
সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করা হবে ॥ খেয়াল খুশি মতো ধর্মকে ব্যবহার করলে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এক শ্রেণির মানুষ ফায়দা নিতে চাচ্ছেন। যারা ধর্ম ব্যবসায়ী সৃষ্টিকর্তা তাদের সঠিক বিচার করবেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে জাতীয় ইমাম সমিতির মহানগর কমিটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে কথাগুলো বলেছেন, নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ইমাম সমিতির মহানগর শাখার সভাপতি মাওলানা কাজী আবদুল মান্নান। নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত অবহেলিত বরিশাল নগরীকে একটি আধুনিক সমৃদ্ধশালী স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নৌকা মার্কায় ভোট প্রার্থনা করেন। পাশাপাশি অঙ্গীকার করেন, ১২ জুনের নির্বাচনে আমি মেয়র নির্বাচিত হতে পারলে নগরীর প্রত্যেকটি মসজিদ, মাদ্রাসাসহ সকল ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নয়ন করা হবে।
অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে নৌকাকে বিজয়ী করুন ॥ জেলা, মহানগর ও ৩০টি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, বরিশাল হচ্ছে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের বিভাগীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর। তাই বরিশাল সিটি নির্বাচনে নৌকা পরাজিত হলে আমরা পরাজিত হবো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত হবেন। যার প্রভাব পরবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা পরাজিত হলে আমাদের কারও কোন অস্থিত্ব থাকবেনা। নানক বলেন, নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও প্রতীক কিন্তু নৌকা পরিবর্তন হয়নি। তাই নৌকার সম্মান রক্ষায় কারো মধ্যে কোন ধরনের রাগ কিংবা ক্ষোভ রাখা যাবেনা। কারণ নৌকা পরাজিত হলে, তার দায়ভার কিন্তু কেউ এড়াতে পারবেন না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে ১২ জুনের নির্বাচনে নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করতে হবে। নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনায় কেন্দ্রীয় টিমের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা, মহানগর ও ৩০টি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকগণ উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গঠিত সাংগঠনিক টিমের সমন্ময়ক ও দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিমের সভাপতিত্বে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, সদস্য গোলাম রাব্বানী চিনু, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু প্রমুখ।
চাচা ইন, ভাতিজা আউট ॥ জাতীয় পার্টির লাঙল মার্কার মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস বলেছেন, বরিশালের রাজনীতিতে চাচা ইন, ভাতিজা আউট হয়েছে। যখনই আওয়ামী লীগ সরকার চাচাকে মনোনয়ন দিয়ে বরিশাল পাঠিয়েছে তখনি ভাতিজার রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। তিনি (ভাতিজা) মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে আর বরিশাল ফেরেননি। প্রায় দুইমাস ধরে মেয়র ছাড়া চলছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম। তাপস আরও বলেন, পরিবারতন্ত্র বা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ সরকার বরিশালে কাজ করছেন। তবে এবার ভোটের মাধ্যমে জবাব দিবে বরিশালের জনগণ। বরিশাল সিটির বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, বরিশালে তিনি কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি। প্রতিটি সেক্টরেই তার চরম ব্যর্থতা। ফলে লজ্জার মুখ লুকাতে তিনি বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। হাতপাখা মার্কার মেয়র প্রার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে উদ্দেশ্য করে তাপস বলেন, বরিশাল সিটির ভোটার না হয়েও সিটি নির্বাচনের তিন মাস আগে তিনি এক মুরিদের বাসার ঠিকানা দিয়ে সিটিতে ভোট নিয়ে আসেন। এতোদিন বরিশালের বাহিরে রাজত্ব করেছেন এখন বরিশালে আসছেন রাজত্ব করার আশায়। হাতপাখার প্রার্থীর উদ্দেশ্যে তাপস আরও বলেন, আগে বরিশাল নগরীতে স্থায়ীভাবে থাকেন, মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে মানুষের জন্য নিবেদিত করেন। তারপর নগরবাসীর জন্য উন্নয়ন করার কথা বলুন। আপনিসহ আপনাদের পরিবারের সদস্যরা চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদে একটানা বিশ বছরের অধিক সময় ধরে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন। এই দীর্ঘ মেয়াদে আপনারা ওই ইউনিয়নে কোনধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারেননি। শুধু নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন করেছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে কাজ নিতে নাকি আপনাদের আত্মসম্মানে লাগে। তাহলে মৃত বরিশাল নগরীতে উন্নয়ন করবেন কিভাবে। নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় উঠান বৈঠকে লাঙলের প্রার্থী এসব কথা বলেছেন।
পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলা হবে ॥ ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা মার্কার মেয়র প্রার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেছেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্ধিত বিশাল এলাকার ভোটাররা এখনো নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। করপোরেশনের নির্ধারিত ট্যাক্স পরিশোধ করেও রাস্তাঘাট, বর্জ্য অব্যবস্থাপনা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার অভাবে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে জলাবদ্ধতা ও মশার উপদ্রব। তিনি আরও বলেন, আমি মেয়র নির্বাচিত হলে বর্ধিত এলাকা নিয়ে বিশেষ প্ল্যান তৈরি করে চলাচলের জন্য প্রশস্ত রাস্তা, যথাযথ পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, মশক নিধনে কার্যকরী বিশেষ ব্যবস্থা, এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে এবং সবুজায়নে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে কমিটি গঠণ করে কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ, শতভাগ পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিতের মাধ্যমে ওই এলাকাকে আধুনিক সকল সুবিধা সম্বলিত পরিকল্পিত ও দৃষ্টিনন্দন নগরী হিসেবে গড়ে তুলবো। নগরীর ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বরফকল ও কেডিসি এলাকায় গণসংযোগকালে হাতপাখা মার্কার প্রার্থী এসব কথা বলেছেন।
নীরব ভোট বিপ্লব হবে ॥ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে টেবিল ঘড়ি মার্কার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সদ্য বিএনপি থেকে আজীবনের জন্য বহিস্কার হওয়া কামরুল আহসান রূপন বলেছেন, আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারলে গাজীপুরের মতো বরিশালেও টেবিল ঘড়ি মার্কার পক্ষে নীরব ভোট বিপ্লব ঘটবে। নগরীর চকবাজার ও গীর্জামহল্লা এলাকায় গণসংযোগকালে রূপন এসব কথা বলেছেন। বিএনপি থেকে আজীবন বহিস্কার প্রসঙ্গে রূপন বলেন, আমি সবসময় জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী একজন মানুষ। বর্তমানে দলে আমার কোন পদণ্ডপদবি ছিলোনা, তবুও আমাকে বহিস্কার করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় আমি বিএনপির লোক। এখন বিএনপির ভোটাররা আমার প্রতি আরো আস্থার সাথে তাদের ভোট প্রদান করবেন।