চীনা কূটনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমেই কর্তৃত্ব হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। একসময়ের মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে মতবিরোধ বাড়ছে ওয়াশিংটনের। পশ্চিমা বলয় থেকে বের হয়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ সৌদি। এদিকে রিয়াদের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পৃক্ততা বাড়ায় উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন। কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের ভরসার আশ্রয় ছিল সৌদি আরব। কিন্তু গত কয়েক মাসে বদলে গেছে বিশ্ব ভূ-রাজনীতির বাতাস। সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের শত্রুতার অবসান ঘটে সৌদি আরবের। রিয়াদ তেল উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়ায় বিশ্ব বাজারে দ্রুত বেড়ে গেছে তেলের দাম। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার পশ্চিমা পদক্ষেপেও তেমন সাড়া দেয়নি তারা। কিন্তু কেন সৌদি আরব অন্যপথে হাঁটার সাহস দেখাচ্ছে? অনেকের মতে, এজন্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই দায়ী। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে জড়ানোয় শীতলতার শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। দিনে দিনে সেটা বেড়েই চলছে। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র এখন পশ্চিম এশিয়া থেকে কূটনৈতিক ও সামরিক নজর সরিয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। অথচ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানির অন্যতম উৎস সৌদির তেল। আগামী জুলাই থেকে দৈনিক আরও ১০ লাখ ব্যারেল তেল কম উৎপাদন করবে সৌদি আবর। দেশটির এমন ঘোষণায় বিশ্ববাজারে বাড়তে শুরু করেছে জ্বালানি তেলের দাম। তাই চুপচাপ বসে থাকতে পারেনি ওয়াশিংটন। এমন সিদ্ধান্তে সৌদি আরবে উড়ে যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরব কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার চালু করার পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে দেশে গেলেন। টানাপোড়েন অবসানে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক হলেও তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। সৌদি যুবরাজের সঙ্গে ব্লিঙ্কেনের ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের বৈঠকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিপরীতে নিজেদের বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছে রিয়াদ। তবে ব্লিঙ্কেনের আলোচনার লক্ষ্য ছিল চীন ও সৌদি আরব যাতে খুব কাছাকাছি না আসে তা নিশ্চিত করা। তবে ওয়াশিংটনের এই দাবি পাত্তা পায়নি বলেই গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে। আরব বিশ্বে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা ধারণা দিন দিন জোরালো হচ্ছে- বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আরব বিশ্বে এমন কথা এখন খোলাখুলি বলা হচ্ছে যে, তাদের এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের দিকে না তাকিয়ে বহুমুখী সম্পর্কের পথ নিতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাহ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকবে না বলে মনে হচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতি ও রাজনৈতিক শক্তি’। উপসাগরীয় দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সম্পর্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দেশ দুটির মধ্যে ২০২১ সালে ব্যবসা হয়েছে ৮ হাজার কোটি ডলারের। সৌদি আরব এখন চীনের জ্বালানি তেলের প্রধান যোগানদারও। বিশ্লেষকরা বলছেন, কৌশলগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের সম্পৃক্ত হয়ে পড়া নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে ওয়াশিংটনের। এ ছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলাতে হুয়াওয়ে টেলিকম নিয়ে চিন্তিত বাইডেন প্রশাসন। চীন এখন সৌদি আরবে সামরিক ড্রোন তৈরিতে সাহায্য করছে। এমনকি বছর খানেক আগে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সৌদি আরবকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনেও সাহায্য করছে বেইজিং। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এককভাবে ছড়ি ঘুরানোর গলার কাঁটা এখন চীন। সৌদি আরব ও ইরানের সম্পর্ক গভীর হলে সুবিধা পাবে গোটা মধ্যপ্রাচ্য। ইয়েমেন ও সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চললেও মূলত এর পেছনে রয়েছে সৌদি আরব ও ইরান। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার হলে তাদের সংঘাত শীতল হয়ে যাবে। যার বাস্তব প্রতিফলন এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। সিরিয়াকে এরইমধ্যে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে আরব লিগের সদস্যপদ। ইয়েমেনেও সংঘাত বন্ধে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সৌদি আরবের আলোচনা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই আকস্মিক পরিবর্তন দেখে হোঁচট খেয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। আর সৌদি আরব-ইরানের মধ্যে উত্তেজনা জিইয়ে রেখে বছরের পর বছর সুবিধা নেয়া যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে আবারও আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কোন পথে এগোবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, রিয়াদণ্ডতেহরান সম্পর্ক জোরদারে চরম আতঙ্কে মধ্যপ্রাচ্যের ‘ক্যনসার’ ইসরাইলও।